হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে আল-কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে- ‘আমি আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমত (করুণা) রূপে প্রেরণ করেছি।’ (আল-কোরআন, সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭)।
‘কত মহান প্রভু তিনি যিনি (আল্লাহ) তার বান্দার (নবী মুহাম্মাদ) প্রতি ফুরকান’ (সত্য এবং ভ্রান্তির মধ্যে পার্থক্যকারী) গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন- যাতে তিনি বিশ্ব জগতের জন্য সতর্ককারী (নাজির) হতে পারেন।’ (আল-কোরআন, সূরা ফুরকান ২৫ঃ১)।
আল-কোরআনে আরো বলা হয়েছে- আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদদাতা (বাছির) এবং সতর্ককারী (নাজির) রূপে প্রেরণ করেছি (আল-কোরআন, সূরা সা’বা ৩৪:২৮)
আল-কোরআনে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে উল্লেখ করা হয়েছে উম্মি রাসূল হিসেবে। যেমন- ‘যারা বার্তাবাহক উম্মি মূল সত্যের প্রতিরূপ রাসূলকে অনুসরণ করে- যার উল্লেখ রয়েছে তাওরাত এবং ইঞ্জিলে- যা তাদের কাছে রক্ষিত আছে।’ (সূরা আরা’ফ ৭:১৫৭)।
কল্কির অবতার : হিন্দু ধর্মগ্রন্থে কল্কি (কলি যুগের প্রেরিত) অবতারের আগমন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। কল্কি এবং কলি একই অর্থবোধক শব্দ। এ শব্দ দুটির অর্থ হলো পাপ। কল্কি যুগ অথবা কলি যুগ অর্থ পাপের যুগ। কলকি অবতারের যে সব বৈশিষ্ট্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে- তা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মপ্রচারক অপেক্ষা হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। হিন্দুদের বিশ্বাস এই যে, সমগ্র মানবতার জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে একজন চূড়ান্ত অবতারের আবির্ভাব হবে। যিনি তার অনুসারীদের মধ্যে সকল পাপ বিনাশ করবেন এবং সমগ্র মানবতার প্রতি হবেন আশীর্বাদ স্বরূপ।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ঐ চূড়ান্ত অবতারের সম্পর্কে কিছু নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে যার দ্বারা সর্বশেষ বা চূড়ান্ত অবতারকে চিহ্নিত করা সহজ হয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখিত চূড়ান্ত অবতারের বৈশিষ্ট্যসমূহ হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। যে সমস্ত ঘটনার উল্লেখ হিন্দু ধর্মগ্রন্থে করা হয়েছে- তার অনেকগুলো হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবন সংঘটিত হয়েছে। কলকি অবতার বা কলিযুগের অবতার সম্পর্কে যে সব কথা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে- তার কিছু কিছু ইঙ্গিত এখানে করা যেতে পারে।
কল্কি যুগের অবতারের নাম : কলকি পুরাণে উল্লেখিত কলকি অবতার বা দেবতার নাম হবে ‘সর্বানম’ অথবা ‘সর্ব-আনম’। ‘আনম’ শব্দের অর্থ হলো যার নাম উল্লেখ করে নমনম বা স্তবস্তুতি করা হয়েছে। স্তবস্তুতি হলো দেবতাদের প্রশংসা কীর্তন। সর্ব শব্দের অর্থ হলো সকল বা সমস্ত। কলকি দেবতা হলেন সর্বনম অর্থাৎ সকলের নম বা প্রশংসা পাওয়ার উপযুক্ত।
সুশ্রম : কলিক অবতারের আরেকটি নাম হলো সুশ্রম। সংস্কৃত ভাষায় সুশ্রম শব্দের একটি অর্থ হলো সুপ্রশংসিত অথবা প্রশংসারযোগ্য (ঋগবেদ)। প্রশংসারযোগ্য শব্দদ্বয়ের আরবি প্রতিশব্দ মুহাম্মাদ। আরবি ভাষায় ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটির অর্থ হলো প্রশংসিত। সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম প্রতিদিনই তার প্রশংসাসূচক দরূদ এবং সালাম পাঠ করেন। মানব জাতির মধ্যে অন্য কোনো ধর্ম প্রচারকের প্রশংসাসূচক এরূপ সর্বস্তুতি বা নাত পেশ প্রতিদিন নিয়মিত করা হয় না।
বস্তুতঃ হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম ‘মুহাম্মাদ’ শব্দটি একটি সর্বস্তুতি বা প্রশংসাসূচক নাম। আরবি মুহাম্মাদ শব্দটির অর্থ প্রশংসিত। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে এ মুহাম্মাদ শব্দটি সমগ্র মুসলিম জাতির পক্ষ থেকে ¯্রষ্টার দূতের প্রতি সার্বজনীন প্রশংসা হিসেবে বিবেচিত হয়।
কল্কি অবতারের বংশ মর্যাদা : ভাগবত পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কলকির অবতারের জন্ম হবে ব্রাহ্মণ বা মহান্ত পরিবারে। ব্রাহ্মণ এবং মহান্ত শব্দ দুটির অর্থ হলো সর্বোচ্চ ব্রাহ্মণ বা মহান্ত বা উপাসক। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম মক্কার কুরাইশ বংশে এবং হাশিম পরিবারে। কুরাইশ বংশ আরবের সবচেয়ে সম্মানীত বংশ। এ বংশের হাশিম উপবংশ বা পরিবার ছিল আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবার।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ তার বিবাহের পর এবং পুত্রের জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বনবীর পিতামহ আবদুল মোতালিব ছিলেন তদানীন্তন মক্কা- তথা সমগ্র আরবের সবচেয়ে সম্মানীত ব্যক্তি। ভাগবত পুরাণ অনুসারে কলকি অবতারের জন্ম যে ব্রাহ্মণ মহান্ত পরিবারে হওয়ার কথা- সেরূপ একটি পরিবারই ছিল আবদুল মোতালিব পরিবার। মোতালিব পরিবার ছিল হাশিমি বংশ ও কুরাইশ গোত্রভুক্ত।
কল্কি পুরাণে বলা হয়েছে, আরব দেশে এক তারকার উদয় হবে এবং তার কারণে আরব দেশ গৌরব এবং সম্মানের অধিকারী হবে। কল্কি পুরাণের পর কোনো অবতারের আবির্ভাব হবে না। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় সমগ্র আরব ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তিনি মানব জাতির জন্য একজন উজ্জ্বল এবং উৎকৃষ্ট মানব হিসেবে আবির্ভূত হন।
ভবিষ্য পুরাণে কলকি অবতার সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে যার সাদৃশ্য আরবের হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যে পাওয়া যায়। ভবিষ্য পুরাণের মধ্যে ‘মোহমদ’ এবং ‘আহমাদ’ আরব নবীর এ দুটি নামেরও উল্লেখ রয়েছে (ভবিষ্য পুরাণ, তৃতীয় খ-, ৩, ৩, ৫-২৭)।
মাতা-পিতা : কলকি অবতারের মাতা-পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে বৈষ্ণবদেব-সুমতি (কলকি পুরাণ, অধ্যায় ২, শ্লোক-২)। বৈঞ্চব শব্দের অর্থ হলো ঈশ্বরের দাস এবং সুমতি শব্দের অর্থ হলো শান্তি ও ¯িœগ্ধতা। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পিতার নাম আবদুল্লাহ। আরবি আবদ শব্দের অর্থ হলো দাস। আবদ এবং আল্লাহ এই দুটি শব্দ সংযুক্ত হয়ে আরবি ব্যকরণ অনুসারে তৈরি হয়েছে আবদুল্লাহ শব্দটি। আবদুল্লাহ শব্দের অর্থ হলো আল্লাহর বান্দা বা আল্লাহর দাস।
রাসূল (সা.)-এর মায়ের নাম আমিনা। আরবি আমিনা শব্দটির অর্থ হলো শান্তি ও ¯িœগ্ধতা। এখানে দেখা যায়- কলকি দেবতার পিতার নাম বৈঞ্চুব দেব এবং মাতার নাম সুমতী শব্দগুলোর সঙ্গে আবদুল্লাহ এবং আমিনা শব্দের আশ্চর্যজনক মিল বা নৈকট্য আছে।
বিঞ্চুব এবং বিঞ্চু ব্যস শব্দ দ্বয়ের অর্থ কি? বিঞ্চু হলেন হিন্দুদের তিন ঈশ্বরের অন্যতম। ব্যস অর্থ চাকর। ব্যস অর্থ ভগবান বা মানুষও হয়। বিঞ্চু ব্যস এ দু’শব্দের অর্থ হলো ঈশ্বর বিঞ্চুর দাস বা পূজারি। আরবি আবদুল্লাহ শব্দের অর্থ হলো আল্লাহর আবদ বা দাস এবং উপাসনাকারী।
কলকি পুরাণ এবং ভাগবত পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কলকি অবতারের পিতা কলকির অবতারের জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করবে (কলকি পুরাণ, ভাগবত পুরাণ-১২) মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পিতা তার মাতৃগর্ভে থাকাকালেই মৃত্যুবরণ করেন। কলকি অবতারের মাতা তার জন্মের ছয় বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। এ দুটি তথ্য থেকেও বোঝা যায় হিন্দু ধর্মের কলকির অবতার হবে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) কারণ, হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের কয়েক মাস পূর্বেই তার পিতা ইন্তেকাল করেন- তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালেই। শিশু মুহাম্মাদের ছয় বছর বয়ঃক্রমকালে তার মাতা ইন্তেকাল করেন।
জন্ম তারিখ : কলকি পুরাণে বলা হয়েছে যে, কলকি অবতারের জন্ম হবে ১২ বৈশাখ (কলকি পুরাণ, অধ্যায়-২, শ্লোক-১৫)
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ১২ রবিউল আউয়াল। হিন্দু এবং হিন্দি শাস্ত্রে বৈশাখ হলো অত্যন্ত সম্মানিত এবং বিখ্যাত মাস। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে কলকি দেবতার জন্ম হবে ৬২৮ বাকরমি সনের ১২ বৈশাখ। কলকি অবতারের জন্ম তারিখ ১২ বৈশাখ এবং হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ১২ রবিউল আউয়ালের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। ইংরেজি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহাম্মাদের মৃত্যু হয়। কলকি দেবতার জীবনকাল এবং হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনকাল কাছাকাছি অনুমিত হয়।
হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ হলো তুলসী দাস রচিত মহা-উপাখ্যান রামায়ন। সংগ্রাম পুরাণের ১২ খ-ে এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে যার বর্ণনা করা হয়েছে তার কিছু কিছু রামায়নে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তুলসী দাস বলেন, ‘আমি কারো প্রতি মুগ্ধ হয়ে শাস্ত্রীয় কথা বলতে চাই না। বেদ এবং পুরাণ গ্রন্থসমূহে সাধু ও ঋষিগণ যা বর্ণনা করেছেন তাতেই আমি আমার বক্তব্য সীমিত রাখবো’। “কলকি অবতার জন্মগ্রহণ করবেন সপ্তম বাকরামী শতাব্দীতে। তিনি আলোকিত হবেন তাঁর ‘চারজন সূর্যসম ঋষি’ দ্বারা। তিনি আবির্ভূত হবেন গভীর তমসায় আচ্ছন্ন একটি দেশ ও সম্প্রদায়ে।”
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। ঐ সনটি ছিল ছয়শ’ আটাশ বাকরমী সনের ১২ বৈশাখ। ৬২৮ বাকরমী সাল ৭ম শতাব্দীর ঘটনা। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর চারজন খলিফার আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রা.)-এর খ্যাতি এবং দ্বীপ্তি মুসলিম বিশ্বে সূর্যের ন্যায়। তাদেরকে মুসলিমগণ, মুসলিম উম্মাহ্ বা জাতির সূর্য হিসেবে গণ্য করে। ‘কলকি অবতার’ তাঁর ধর্ম প্রচার করবেন প্রজ্ঞা (হিকমত) ও জ্ঞানের (ইলম) সাথে। তিনি সু-সংবাদ শুনাবেন (বাশীর) এবং নিষিদ্ধ বিষয় (হারাম) ঘোষণা করবেন।
কলকি পুরাণের উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনের বাণীর সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। আল-কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘হে নবী’ আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি। সু-সংবাদদাতা হিসেবে, সতর্ককারী রূপে ও স্বাক্ষী হিসেবে (আল-কোরআন, সূরা-আহযাব, ৩৩:৪৫)
আপনি প্রেরিত হয়েছেন আল্লাহ্্র নির্দেশে। তাঁর (আল্লাহ্্র) দিকে আহ্বানকারী রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে (আল-কোরআন, সূরা-আহযাব, ৩৩:৪৬)। আপনি মুসলিমদেরকে সু-সংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহ্্র নিকট রয়েছে মহাঅনুগ্রহ (আল-কোরআন, সূরা-আহযাব, ৩৩: ৪৭)।
জন্মস্থান : ভাগবত পুরাণে কলকির অবতারের জন্মস্থান বলা হয়েছে ‘সম্বল গ্রাম’।
সম্বল গ্রামের অর্থ হলো সম্মানজনক গ্রাম, যেখানে ব্রাহ্মণ মহান্ত (ধর্মীয় ঋষি) বাস করে থাকেন (ভাগবত পুরাণ, খ--১২, শ্লোক-১৮; কলকি পুরাণ অধ্যায়-২, শ্লোক-৪)। সম্বল শব্দের অর্থ হলো শান্তি। সম্বল গ্রাম অর্থ হলো শান্তিধাম অর্থাৎ শান্তিনগর বা শান্তিপূর্ণ গ্রাম। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মস্থান হলো মক্কা নগরীতে। মক্কা ছিল আরবের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ স্থান। এটা ছিল ধর্মীয় তীর্থস্থান। ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক কল্যাণের জন্য মূর্তি পূজক আরবগণ আরবের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নগরী মক্কায় মিলিত হতেন। শান্তিপূর্ণ নগরী বিধায় মক্কা ছিল বাণিজ্য নগরী। মূর্তি পূজক আরবগণ নানাবিধ কুসংস্কার পাপাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও হত্যাকা-ে লিপ্ত হতো। যেহেতু মক্কায় এ ধরনের প্রবণতা কম ছিল, তাই এ নগরীটি আরবের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্রে উন্নীত হয়।
আল-কোরআনে মক্কা-মুকাররামা বা সম্মানিত নগরীর উল্লেখ করা হয়েছে বালাদুল আমিন শব্দদ্বয়ে। বালাদুল (নগরী) আমীন (নিরাপদ) শব্দের অর্থ হলো শান্তিপূর্ণ নগরী (সূরা ইব্রাহিম, ১৪:৩৫)
এই নগরীকে শান্তির নগরী হিসেবে উন্নীত করার জন্য হজরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ্্র নিকট মোনাজাত বা প্রার্থনা করেছিলেন।
কলকি অবতারের নাম ও আবির্ভাব স্থান : ভবিষ্য পুরাণে বর্ণিত আছে যে, একটি বিদেশি ভাষা-ভাষি একজন ম্লেচ্ছ আধ্যাত্মিক শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটবে। তিনি শিষ্য-সাথী পরিবেষ্টিত থাকবেন। তাঁর নাম হবে মোহ-মদ। ভারতের রাজা ভোজ এই দেব প্রকৃতির মোহদেব আরবকে পঞ্চগঙ্গা এবং গঙ্গাজলে ¯œান করাবেন। অর্থাৎ তাকে পাপমুক্ত করবেন এবং তাকে অর্পণ করবেন অনেক ভক্তি এবং বলবেন, আমি আপনার আনুগত্য স্বীকার করি। হে মানবতার গৌরব! পবিত্র স্থানের অধিবাসী। আপনি শয়তান দানবকে হত্যার জন্য বিরাট বাহিনী সৃষ্টি করেছেন। আপনি আপনার নিজেকে ম্লেচ্ছ প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে মূর্তি পূজক এবং অসভ্যদের থেকে আত্মরক্ষা করে চলুন।
হে মহাপবিত্র ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি! সর্ববৃহৎ দেবেশ্বর! আমি আপনার দাস। দাস হিসেবে আমাকে আপনার পদতলে আশ্রয় দিন (ভবিষ্য পুরাণ)।
ভবিষ্য পুরাণে আরো বলা হয়েছে- ম্লেচ্ছগণ অতিপবিত্র এবং পরিচিত আরব ভূমিকে বিনষ্ট করে ফেলেছে। ঐ দেশে আর্য ধর্মের কোন অস্তিত্ব নেই (ভবিষ্য পুরাণ)
ভবিষ্য পুরাণে কলকি অবতারকে সুস্পষ্ট ভাষায় মোহ-মদ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ভিন্ন অন্য কোন নবী মুহাম্মাদ বা মোহ-মদ নামে উল্লেখিত হননি।
ভবিষ্য পুরাণে উল্লেখিত সংস্কৃত মরুস্থলে শব্দটির অর্থ হলো মরুভূমি অথবা বালুকাচ্ছাদিত বিরাট ভূমি। এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, কলকি অবতার আবির্ভূত হবেন ভারত থেকে নয় বরং মরুস্থল বা মরুভূমি থেকে।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছাড়া অন্য কোন নবী সম্পর্কে ভবিষ্য পুরাণে উল্লেখিত মোহ-মদ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে না। মরুস্থলের মধ্যে হজরত মুহাম্মাদ ভিন্ন অন্য কোন নবীর আবির্ভাব বহু শতাব্দী পর্যন্ত হয়নি।
এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, আর্য ধর্মের আবির্ভাব ও বিকাশ আরবে হয়নি, হয়েছে ভারতে। আরব নবী পঞ্চগয়াতে স্নান করেননি এবং গঙ্গা জল দিয়ে তাকে স্নান করানো হয়নি।
পবিত্র গঙ্গা জল শব্দটি ভবিষ্য পুরাণে যে উল্লেখ রয়েছে তা একটি ভাষারীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দ্বারা গঙ্গা জল নয় বরং পবিত্র জল বুঝানো হয়েছে। আরব দেশে পবিত্রতম পানি হলো জমজমের পানি। জমজমের পানিতে হাজিগণ স্নান করেন। তারা মনে করেন যে, জমজমের পানি দিয়ে স্নানের ফলে দেহ এবং হৃদয় থেকে অনেক অপবিত্রতা দূরীভূত হয়। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে তাঁর অনুসরীগণ মাসুম বা নিষ্পাপ মনে করেন।
ভবিষ্য পুরাণে রাজা ভোজকে বলা হয়েছে, ‘তোমার পূর্বে ও বহু সৎপথভ্রষ্ট শয়তান বা পিশাচের আবির্ভাব হয়েছিল। যাকে আমি হত্যা করেছি।’ অত্যন্ত শক্তিশালী শত্রু কর্তৃক তাকে পুনরায় ভূ-খ-ে প্রেরণ করা হয়েছে। এই বিভ্রান্ত শত্রুদেরকে সৎ পথ প্রদর্শনের জন্য এবং সু-নির্দেশনার জন্য বিখ্যাত মোহ-মদকে (মুহাম্মাদ) প্রেরণ করা হয়েছে। তাকে ব্রহ্ম আখ্যা দেয়া হয়েছে। তিনি পিশাচদেরকে সঠিক ধর্মপথে আনয়নের চেষ্টা করছেন। হে রাজা ভোজ! বর্বর পিশাচদের দেশে তোমার যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যেখানে আছ সেখানেই আমার দয়ায় পবিত্রতা অর্জন করবে। (ভবিষ্য পুরাণ)।
পর্বতে কলকি অবতারের দৈববাণী লাভ : কলকি পুরাণে উল্লেখ আছে যে, দেবদূত পরশুরামের মাধ্যমে কলকি অবতার পর্বত গুহায় দৈববাণী লাভ করবেন। এটা সর্বজন জ্ঞাত যে, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হেরা গুহায় জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াত বা রিসালাতের দৈববাণী লাভ করেন। তাঁর উপরে নাজিলকৃত ওহীর মাধ্যমে। প্রথম নাজিলকৃত আল-কোরআনের বাণীটি হলো ‘ইক্্রা বিসমি রাব্বীকা’ যার অর্থ হলো-‘পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানব প্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন আলাক (জমাট রক্ত) থেকে’- এ বাণী হেরা গুহায় নাজিল হয়েছিল (সূরা আলাক, ৯৬ :১-৩)।
জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ্্র নামে পড়ার জন্য আদিষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিতে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছিলেন, ‘আমি ছাত্র নই’
প্রথম নবুওয়াতের ঘটনাটির অনুরূপ ঘটনা বাইবেলে ঈছাই অধ্যায়ের ১২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে (ঈছাই অধ্যায় ২৯, আয়াত-১২)- জিব্রাঈলের পড়তে অনুরোধের প্রেক্ষিতে রাসূল (সা.) বলেন, আমি ছাত্র নই।
প্রচার, প্রতিবাদ, হিজরত, মক্কায় প্রত্যাবর্তন : কলকি পুরাণে উল্লেখ আছে যে, কলকি অবতার তার প্রচার মিশন ‘সাম্ভাল’ গ্রাম থেকে শুরু করবেন। কিন্তু উক্ত সাম্ভাল গ্রাম বা নগরীর অধিবাসীগণ কলকি অবতারের বিরুদ্ধে উত্থান ঘটাবে। তাঁর উপর নির্যাতন করবে এবং তিনি পর্বত ঘেরা অন্য একটি শহরের দিকে পলায়ন করবেন। অবশেষে কয়েক বছর পর তিনি তাঁর নগরীতে স্বশস্ত্রভাবে তরবারী হস্তে প্রত্যাবর্তন করবেন। শুধুমাত্র সাম্বাল নগরীই নয়। সমগ্র দেশই তাঁর পদানত হবে।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মনগরী মক্কা ত্যাগ করে তাঁকে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছিল। মদিনা নগরীও বিশেষ বিশেষ দিকে পর্বত ঘেরা ওহুদ প্রান্তর ও পর্বত মদিনার চার মাইলের মধ্যে অবস্থিত। এই ভবিষ্যৎ বাণীটিও সর্বাংশে সত্য হয়ে যায় হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ক্ষেত্রে।
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আরব উপদ্বীপের অন্তর্গত মক্কা নগরীতে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কিন্তু জনগণের বাধা এবং নির্যাতনের কারণে তাকে চিরজীবনের জন্য মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হতে হয়। কয়েক বছর পর তিনি দশ হাজার সঙ্গী সাথীসহ মক্কায় ফিরে আসেন। শুধু মক্কা নয়, সমস্ত আরবমুলক তাঁর দখলে চলে আসে।
যুদ্ধকালে কলকি অবতারের সাহায্য প্রাপ্তি : কলকি পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে, কলকি অবতার যুদ্ধকালে দেবদূতের সাহায্য পাবেন (কলকি পুরাণ, অধ্যায়-২, শ্লোক-৭)- যুদ্ধকালে দেবদূত বা ফেরেশতাদের সাহায্য প্রাপ্তি সংক্রান্ত ঘটনা হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনে ঘটে। তিনি বদর এবং ওহুদের যুদ্ধে ফেরেশতাদের সাহায্য পেয়েছিলেন।
ঈশ্বর থেকে উড়ন্ত অশ্ব প্রাপ্তি : ভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে যে, কলকি দেবতা ঈশ্বর থেকে একটি উড়ন্ত অশ্ব লাভ করবেন। ঐ অশ্বটি হবে বজ্র-বিদ্যুতের থেকে অনেক বেশি দ্রুতগামী। এ অশ্বে আরোহন করে কলকির অবতার সমগ্র পৃথিবী এবং সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করবেন (ভাগবত পুরাণ, খ--১২, অধ্যায়-২, শ্লোক-১৯-২০)- কলকি অবতারের সপ্তাকাশ পরিভ্রমণের ঘটনার সাথে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মিরাজের ঘটনার আশ্চর্য মিল রয়েছে।
আল-কোরআনে বলা হয়েছে, পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন। মাসজিদুল আকসার পরিবেশ বরকতময় করেছেন আল্লাহ্্ তাঁর নিদর্শন দেখাবার জন্য (সূরা বাণী ইসরাঈল, আয়াত-১)
মিরাজের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হাদিস গ্রন্থসমূহে আছে। হাদিসের বর্ণনা মতে, মিরাজের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) সপ্তাকাশ ভ্রমণ করেন এবং অন্যান্য নবীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
এই মিরাজ বা পরিভ্রমণের জন্য আল্লাহ্্তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে বারক (বোরাক) নামে একটি অশ্ব দান করেছিলেন। বারক একটি আরবি শব্দ, এর অর্থ হলো বিদ্যুৎ। মিরাজ শব্দের অর্থ হলো, উচ্চতা এবং মই। মিরাজের ঘটনা থেকেও কলকি অবতারের সাথে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ঘটনার সাদৃশ্য আছে।
লেখক : সাবেক ধর্ম সচিব.