রজবের ২৭ তম রাত। এ রাতে সায়্যিদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার ওই ‘খাস’ (বিশেষ) নৈকট্য হাসিল করেছেন, যা কোন নবী-রসূল এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাও হাসিল করেন নি। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে স্বীয় বিশেষ দরবারে খুবই বড় পর্যায়ের সম্মান সহকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁর সাথে সরাসরি কথোপকথনের মর্যাদা দিয়েছেন, স্বীয় দীদার দিয়েছেন এবং তাঁর উম্মতের জন্য নামায-এর ন্যায় পবিত্র ও মহামর্যাদার ইবাদতের তোহফা দিয়েছেন। ক্বোরআনুল হাকীমে মি’রাজের ঘটনাকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِي بَٰرَكۡنَا حَوۡلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنۡ ءَايَٰتِنَآۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١
“পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদ-ই হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই; নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।”[ ] (তরজমা-ই কান্যুল ঈমান)
অপর স্থানে এসেছে,
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ ٨ فَكَانَ قَابَ قَوۡسَيۡنِ أَوۡ أَدۡنَىٰ ٩ فَأَوۡحَىٰٓ إِلَىٰ عَبۡدِهِۦ مَآ أَوۡحَىٰ ١٠ مَا كَذَبَ ٱلۡفُؤَادُ مَا رَأَىٰٓ ١١ أَفَتُمَٰرُونَهُۥ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ ١٢ وَلَقَدۡ رَءَاهُ نَزۡلَةً أُخۡرَىٰ ١٣
“অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো, অতঃপর খুব নেমে আসলো। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এ মাহবূবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইলো, বরং তদপেক্ষাও কম। তখন ওহী করলেন আপন বান্দার প্রতি, যা ওহী করার ছিল। অন্তর মিথ্যা বলে নি, যা দেখেছে। তবে কি তোমরা তার সাথে তিনি যা দেখেছেন তাতে বিতর্ক করছো? এবং তিনি তো ওই জ্যোতি দু’বার দেখেছেন।”[ ] (তরজমা-ই কান্যুল ঈমান)
আরো এসেছে, مَا زَاغَ ٱلۡبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ ١٧ لَقَدۡ رَأَىٰ مِنۡ ءَايَٰتِ رَبِّهِ ٱلۡكُبۡرَىٰٓ ١٨
“চক্ষু না কোন দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় আপন রবের বহু বড় নিদর্শনাদি দেখেছেন।”[ ] (তরজমা-ই কান্যুল ঈমান)
মি’রাজের বর্ণনা
মি’রাজের ঘটনা সংক্ষেপে এভাবে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ রাতে হাতীম-ই কা’বার মধ্যে আরাম করছিলেন; এ সময়ে হযরত জিব্রাইল আলায়হিস সালাম উপস্থিত হলেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ঝমঝম কুপের কিনারায় নিয়ে গিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করলেন এবং পবিত্র ক্বলবকে ঈমান ও হিকমত দ্বারা ভর্তি করে বক্ষ মুবারককে ঠিক করে দিলেন। অতঃপর হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতী বুরাক্বের উপর আরোহন করানো হল, যেটার দ্রুতগামী হওয়ার অবস্থা এমন ছিল যে, দৃষ্টি যেখানে গিয়ে পতিত হয়, সেখানে তার কদম রাখত; আক্বা ও মাওলা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেটার উপর আরোহী হয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। হুযূরের সুমহান ইরশাদ হচ্ছে: “আমি বায়তুল মুক্বাদ্দাস গমনকালে হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর ক্ববরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখলাম, তিনি স্বীয় কবরে দন্ডায়মান হয়ে নামায আদায় করছেন।”[ ] বায়তুল মুক্বাদ্দসে সমস্ত নবী আলায়হিমুস সালাম সায়িদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তারপর সকলেই সায়্যিদুল আম্বিয়া আলায়হি সালাতু ওয়াস সালাম-এর ইমামতিতে নামায আদায় করেন। অতঃপর হুযূর প্রথম আসমানে তাশরীফ নিয়ে গেছেন। সেখানে হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে; দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা ও ইয়াহ্ইয়া আলায়হিস সালাম-এর সাথে; তৃতীয় আসমানে হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস সালাম-এর সাথে; চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস আলায়হিস সালাম-এর সাথে; পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আলায়হিস সালাম-এর সাথে; ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর সাথে এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর সিদ্রাতুল মুনতাহা তাশরীফ নিয়ে গেছেন, সেখানে হযরত জিব্রাইল আলায়হিস সালাম আরয করলেন, আমার আক্বা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আমার নিকট এ স্থান থেকে আগে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। সরকার-ই দো‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একাকী সিদ্রাতুল মুনতাহা থেকে তাশরীফ নিয়ে গেলেন এবং আরশ ও লা মকান-এ উপনীত হলেন। সেখানে তিনি পর্দাহীনভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার দীদার অর্জন করেছেন। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করেছেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা যা ইচ্ছা ওহী করেছেন। হুযূরের প্রতি অপর নি’মাতরাজি ছাড়াও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। হাদীস শরীফে এসেছে,
فَأَوْحَى اللهُ إِلَيَّ مَا أَوْحَى، فَفَرَضَ عَلَيَّ خَمْسِينَ صَلَاةً فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ،
“আল্লাহ্ তা‘আলা (মাধ্যম ছাড়াই) আমার প্রতি ওহী করেছেন, যা ইচ্ছা ওহী করেছেন; আর আমার উপর প্রতি দিনে ও রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।”[ ] অতঃপর হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর বারবার অনুরোধে নয় (৯) বার নামাযের ওয়াক্ত কমানোর জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে হাযির হয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায অবশিষ্ট রইলো এবং সাওয়াব পঞ্চাশ ওয়াক্ত-এরই বিদ্যমান থাকলো। ইরশাদ হচ্ছে,
قَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِنَّهُنَّ خَمْسُ صَلَوَاتٍ كُلَّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، لِكُلِّ صَلَاةٍ عَشْرٌ، فَذَلِكَ خَمْسُونَ صَلَاةً،
“আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন: হে মুহাম্মদ! এগুলো দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায; কিন্তু প্রতি ওয়াক্তের জন্য দশ ওয়াক্ত নামাযের সাওয়াব পাবে। সুতরাং এ পাঁচ ওয়াক্ত নামায সাওয়াবের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সমান।”[ ] এ সুদীর্ঘ সফরের পর হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা-ই মুর্কারামা তাশরীফ আনলেন এবং এ সুদীর্ঘ সফর রাতের সামান্য অংশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ্!
শব-ই মি’রাজের ফযীলত
ইরশাদ-ই বারী তা‘আলা: وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ الله “এবং তাদেরকে আল্লাহ্র দিবসসমূহ স্মরণ করিয়ে দাও!”[ ] (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)
এ আয়াতের তাফসীরে সদ্রুল আফাদ্বিল মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, এ দিবসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহত্বপূর্ণ দিন হচ্ছে, সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ বিলাদত (জন্ম) ও মি’রাজের দিন। এ দিবসদ্বয়ের স্মরণ প্রতিষ্ঠা করাও এ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত। (খাযাইনুল ইরফান) [ ] এর দ্বারা জানা গেল যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মি’রাজ শরীফ সম্পর্কে আলোচনা আল্লাহ্র হুকুমের উপর আমল করা, বরং সুন্নাত-ই ইলাহিয়্যাহ্। যেমনিভাবে ক্বোরআনুল কারীমের বেশ কয়েকটি আয়াত ইতিপূর্বে তরজমাসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি বড় হিকমত হচ্ছে এ যে, লোকদের মাহবূব-ই কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগতি হবে এবং হৃদয়গুলো ও মস্তিস্ক ইশ্ক্ব-ই রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আলো দ্বারা নূরানী হয়ে যাবে।
ইমাম বায়হাক্বী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় শু‘আবুল ঈমান’ গ্রন্থে রেওয়ায়াত করেছেন,
فِي رَجَبٍ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ مَنْ صَامَ ذٰلِكَ الْيَوْمَ، وَقَامَ تِلْكَ اللَّيْلَةَ كَانَ كَمَنْ صَامَ مِنَ الدَّهْرِ مِائَةَ سَنَةٍ، وَقَامَ مِائَةَ سَنَةٍ وَهُوَ ثَلَاثٌ بَقَيْنَ مِنْ رَجَبٍ،
“রজব মাসে এক দিন ও রাত অতি মহিমান্বিত ও ফযীলতপূর্ণ রয়েছে। যে ব্যক্তি ওই দিনে রোযা রাখে এবং রাতে ইবাদত করে, তাহলে সে যেন শত বছর রোযা পালন করলো এবং শত বছর পর্যন্ত ইবাদত করলো। আর এ মহিমান্বিত রাত হচ্ছে, ২৭ তম রাত।”[ ] হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “রজবের সাতাশ তম রাতে ইবাদতকারীদের শত বছরের ইবাদতের সাওয়াব অর্জিত হয়।”[ ] এ বর্ণনা যদিও দ্বঈ’ফ, কিন্তু ফাযাইল-ই আ’মাল-এর ক্ষেত্রে দ্বঈ’ফ রেওয়ায়াতসমূহ গৃহীত হয়।
(মিরক্বাত, আশ‘আতুল লুম‘আত)
মু’মিনগণের মি’রাজ
খোদা তা‘আলা শব-ই মি’রাজে বিশেষভাবে আমাদেরকে নামাযের তোহ্ফা দান করে এটা ইশারা করেছেন যে, দীদার-ই ইলাহী ও খোদাওয়ান্দ তাবারকা ওয়া তা‘আলার নৈকট্য তো রসূলের মি’রাজ এবং নামাযসমূহের মাধ্যমে এ মহাপবিত্র মাওলার রহস্য ও পুরষ্কার হাসিল করা মু’মিনগণের মি’রাজ। এ জন্যে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে একাগ্রতা ও ন¤্রতার এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে-أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ
“তুমি এমনভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করবে যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছো এবং যদি তুমি তাঁকে না দেখো, তাহলে (কমপক্ষে) এ একাগ্রতা সহকারে ইবাদত করো যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তোমাকে দেখছেন।”[ ] হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ، وَهُوَ سَاجِدٌ، فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ
“বান্দা সাজ্দাহ্ অবস্থায় স্বীয় রবের অধিক নিকটবর্তী হয়, সুতরাং তোমরা বেশি পরিমাণে দো‘আ করো।”[ ] এখানে বুঝা গেল যে, শব-ই মি’রাজ হুযূর সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যও মি’রাজের রাত এবং তাঁর উম্মতের জন্যও মি’রাজের রাত।
মুজাদ্দিদ-ই ইসলাম আ’লা হযরত মাওলানা শাহ্ আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন বস্তু দ্বারা মর্যাদাবান হন নি, বরং যে বস্তু হুযূরের প্রতি সম্পর্কিত করা হয়েছে, সেটাই মর্যাদাপূর্ণ হয়ে গেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা অনুত্তম বস্তুসমূহকেও স্বীয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পর্কিত করেন, যাতে ওই বস্তুসমূহের মর্যাদা অর্জিত হয়। সুতরাং পুতঃপবিত্র বিলাদত (শুভ জন্ম) রবিউল আউয়াল শরীফে হয়েছে, রমযান মাসে নয়; সোমবারে হয়েছে, মুবারক দিন জুমু‘আ’র মধ্যে নয়; মওলূদ শরীফের স্থানে হয়েছে, কা’বা মু‘আয্যামায় নয়। (যাতে এ মাস, দিন এবং স্থানও মর্যাদাপূর্ণ আর উত্তম হয়ে যায়।)”[ ] অতএব, যে রাতের এ মর্যাদা অর্জিত হয়েছে যে, তাতে সরওয়ারে কায়িনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মি’রাজ হয়েছে; এতে খোদা তা‘আলা স্বীয় মাহ্বূবকে বিশেষ বিশেষ নি’মাত দ্বারা পুরষ্কৃত করেছেন, আপন দীদার-এর নি’মাত-ই কোবরা দ্বারা মর্যাদাবান করেছেন; তাহলে সে রাতের সম্মান ও বুযুর্গী কী পরিমাণ হবে, সেটা অনুমান করাও সম্ভব নয়।
শব-ই মি’রাজের ইবাদত
নামায: রাতে জাগ্রত হয়ে দু’ দু’ বা চার চার রাক্‘আত করে নিয়্যত করে নফল নামায পড়বে। একবার সালাতুত্ তাসবীহ্ও পাঠ করবে।[ ] বিশেষভাবে এ ১২ (বার) রাক্‘আত নামায অবশ্যই পড়ে নেবে, যার ব্যাপারে হাদীস শরীফে তাগিদ এসেছে। ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
وليلة سبع وعشرين منه وهي ليلة المعراج وفيها صلاة مأثورة فقد قال صلى الله عليه وسلم للعامل في هذه الليلة حسنات مائة سنة فمن صلى في هذه الليلة اثنتي عشرة ركعة يقرأ في كل ركعة فاتحة الكتاب وسورة من القرآن ويتشهد في كل ركعتين ويسلم في آخرهن ثم يقول سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا الله والله أكبر مائة مرة ثم يستغفر الله مائة مرة ويصلي على النبي صلى الله عليه وسلم مائة مرة ويدعو لنفسه بما شاء من أمر دنياه وآخرته ويصبح صائماً فإن الله يستجيب دعاءه كله إلا أن يدعو في معصية
“রজবের ২৭ তম রাত, যা লায়লাতুল মি’রাজ। এতে ‘সালাত-ই মা’সূরা’ রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: এ রাতে ইবাদতকারীদের শত বছরের ইবাদতের সাওয়াব অর্জিত হয়। যে ব্যক্তি এ রাতে বার রাক্‘আত নামায এভাবে আদায় করলো, প্রতি রাকা‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে ক্বোরআনুল হাকীমের যে কোন সূরা পড়বে এবং দু’ রাকা‘আত পর তাশাহ্হুদ শেষ পর্যন্ত পাঠ করে দুরূদ ও দো‘আ-ই মাসূরা’র পর সালাম ফিরাবে। আর বার রাকা‘আত পড়ার পর ১০০ বার এ তাসবীহ্ পাঠ করবে-
سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ-
অতঃপর ১০০ বার أَسْتَغْفِرُ اللهَ এবং ১০০ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে। অতঃপর দুনিয়া ও আখেরাতের বিষয়াদি সম্পর্কে যা কিছু ইচ্ছা হয় দো‘আ করবে এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবে, তাহলে নিশ্চিতভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সমস্ত দো‘আ কবূল করবেন। কিন্তু যদি সে কোন গুনাহের দো‘আ করে (তাহলে এ দো‘আ কবূল হবে না)।”[ ] এ হাদীস শরীফ দ্ব‘ঈফ কিন্তু ফাযাইল-ই আ’মাল-এর ক্ষেত্রে হাদীস-ই দ্ব‘ঈফও গ্রহণযোগ্য।
দো‘আ: প্রত্যেক নামাযের পর দো‘আ করবে। উত্তম হচ্ছে, ক্বোরআন-হাদীসে বর্ণিত দো‘আসমূহ পাঠ করা। দো‘আর পূর্বে এবং পরে দুরূদ শরীফ অবশ্যই পাঠ করবে। হযরত আবূ উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: পাঁচ রাতে কৃত দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হয় না। ১. রজবের প্রথম রাত, ২. শা’বানের পঞ্চদশ রাত, ৩. জুমু‘আর রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত এবং ৫. ঈদুল আযহার রাত।[ ] শব-ই মি’রাজ রজব মাসের সমস্ত রাত অপেক্ষা উত্তম ও মর্যাদাসম্পন্ন, তাহলে এ রাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হবে না, ইন্ শা আল্লাহু তা‘আলা।
রোযা: ২৭ রজব দিনে রোযা রাখবে। উত্তম হচ্ছে, ২৬ রজবও রোযা রাখা। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে মি’রাজের দিনের সাথে রজব মাসে আরো ১৪ টি রোযা রাখবে।
ইমাম বায়হাক্বী ‘শু‘আবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ صَامَ يَوْمًا مِنْ رَجَبٍ كَانَ كَصِيَامِ سَنَةٍ، وَمَنْ صَامَ سَبْعَةَ أَيَّامٍ غُلِّقَتْ عَنْهُ سَبْعَةُ أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، وَمَنْ صَامَ ثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، وَمَنْ صَامَ عَشَرَةَ أَيَّامٍ لَمْ يَسْأَلِ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ، وَمَنْ صَامَ خَمْسَةَ عَشَرَ يَوْمًا نَادٰى مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: قَدْ غَفَرْتُ لَكَ مَا سَلَفَ فَاسْتَأْنِفِ الْعَمَلَ قَدْ بَدَّلْتُ سَيِّئَاتِكُمْ حَسَنَاتٍ،
“যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোযা রাখে, সে যেন পুরো বছর রোযা রাখল; আর যে ব্যক্তি সাত দিন রোযা রাখে, তাহলে তার জন্য দোযখের সাত দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং যে ব্যক্তি এ মাসে আট দিন রোযা রাখে, তার জন্য জান্নাতের আট দরজা উন্মুক্ত করা হয়। আর এ মাসে দশ দিন রোযা পালনকারী আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট যা কিছু দো‘আ করে, তাকে প্রদান করা হবে; আর যে ব্যক্তি পনের দিন রোযা রাখে, তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক আহ্বান করতে থাকে, হে রোযাদার! তোমার ইতিপূর্বের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করেছি, এখন নেক আমল শুরু করো। আমি (আল্লাহ্) তোমার মন্দগুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছি।” [বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, খ– ৫, পৃ. ৩৩৬, হা/ ৩৫২০] অপর বর্ণনায় এসেছে, فِي الْجَنَّةِ قَصْرٌ لِصُوَّامِ رَجَبٍ রজব মাসে রোযাপালনকারীদের জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে।”[প্রাগুক্ত, হা/ ৩৫২১] এ মহিমান্বিত রাত ক্বোরআন তিলাওয়াত, দুরূদ-সালাম পাঠ, নফল নামায, রোযা ও দো‘আ-মুনাজাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা জরুরী। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এ রাতের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করার তাওফীক্ব দান করুন। আ-মীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
টিকা:
আল্ ক্বোরআন, সূরা (১৭) বনী ইসরাঈল, আয়াত: ১
আল্ ক্বোরআন, সূরা (৫৩) আন্ নাজম, আয়াত: ৮-১৩
প্রাগুক্ত, আয়াত: ১৭-১৮
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ৪, পৃ. ১৮৪৫, হা/ ২৩৭৫
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ১, পৃ. ১৪৫, হা/ ২৫৯/১৬২
প্রাগুক্ত
আল্ ক্বোরআন, সূরা (১৪) ইবরাহীম, আয়াত: ৫
খাযাইনুল ইরফান, কৃত: আল্লামা সায়্যিদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী, বঙ্গানুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, পৃষ্টা- ৪৬৬
বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, খ– ৫, পৃ. ৩৪৫, হা/ ৩৫৩০; মা-সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ্, কৃত: শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী, পৃ. ১৭১
ইহ্ইয়াউল ‘উলূম, খ–১, পৃ. ৩৭৩
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ১, পৃ. ৩৬, হা/ ৮.
মুসলিম, আস্ সহীহ্, খ– ১, পৃ. ৩৫০, হা/ ৪৮২; শিকাত শরীফ, হা/ ৮৯৪
ফাতাওয়া-ই রযভিয়্যাহ্, প্রথম খ-, পৃ. ৫৫২
সালাতুত্ তাসবীহ্ আদায় পদ্ধতি জানতে দেখুন ‘গাউসিয়া তরবিয়াতী নেসাব, পৃ- ১৮৬
ইহ্ইয়াউল্ উলূম, بيان الليالي والأيام الفاضلة فضيلة قيام الليل খ– ১, পৃ. ৩৬১
মুকাশাফাতুল ক্বুলূব (আরবী), পৃ. ২৪৯, দায়লামীর সূত্রে বর্ণিত।