ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন
শাহানশাহে সিরিকোট হযরতুল আল্লামা
সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি
[রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি]
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
বিশ্ব-ইতিহাস পর্যালোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয় যে, প্রতিটি যুগ ও শতাব্দিতে সৃষ্টির সেরা মানবজাতি যখন পথহারা হয়ে নানাবিধ গোমরাহী বা পথ ভ্রষ্টতার শিকার হয়ে সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকে, তখন মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে মহান হাদী বা সঠিক পথের দিশারীদের প্রেরণ কিংবা সৃষ্টি করে মানুষকে সঠিক ও কৃতকার্যতার পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। এ পথ প্রদর্শকদের শীর্ষে রয়েছেন সম্মানিত নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম। এ নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর শুভাগমনের ধারা পরিপূর্ণতা লাভ করে নবী ও রসূলকুল শ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পৃথিবীপৃষ্ঠে শুভাগমনের মাধ্যমে। তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রসূল। তাঁরপর আর কোন নবী ও রসূল পৃথিবী পৃষ্ঠে আসেননি, আসবেনও না। ক্বিয়ামতের পূর্বে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম নবী হিসেবে আসবেন না, তিনি আসবেন শেষ যামানার নবীর উম্মত ও তাঁর দ্বীনের প্রচারক ও খিদমতগার হিসেবে। আর এ শেষ যামানার নবীর প্রতিষ্ঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ পরিপূর্ণ দ্বীন-ইসলামকে সেটা আসল রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখার দায়িত্ব বর্তানো হয় এ উম্মতের হাক্কানী রব্বানী ওলামা-ই কেরামের উপর। এ হক্বক্বানী-রব্বানী ওলামা-ই কেরামের এক বিশেষ শ্রেণী হলেন আল্লাহর ওলীগণ।
আরো লক্ষণীয় যে, সম্মানিত নবী-রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম নিজ নিজ যুগে ছড়িয়ে পড়া সব বাতিল বা মিথ্যা এবং পথভ্রষ্টতাকে চিহ্ণিত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে সফল মোকাবেলা করে সেগুলোর স্থলে হিদায়তের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং সত্যকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা তা করতে পূর্ণ সচেষ্ট ছিলেন। নবী ও রসূলগণের ধারা পরিপূর্ণ ও শেষ হবার পর তাঁদের পদাংক অনুসরণ করে এ গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন ও করে যাচ্ছেন তাঁদেরই ওয়ারিসরূপে ইসলামের হক্বক্বানী-রব্বানী ওলামা-মাশাইখ। এর ফলশ্রুতিতে আজ পর্যন্ত ক্বোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা’ ও ক্বিয়াস ভিত্তিক শিক্ষা-দীক্ষা এবং ইসলামের সঠিক রূপরেখা সুন্নী মতাদর্শ বিশ্বমাঝে অম্লান অবয়বে ও স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
একথাও সুস্পষ্ট যে, বিশ্ব থেকে বাতিলকে অপসারণ কিংবা চিহ্ণিত করার জন্য এবং তদস্থলে সত্যকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত নবী-রসূল, বিশেষত: আমাদের আক্বা, নবী ও রসূলকুল শ্রেষ্ঠ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে যেভাবে সর্বদিক দিয়ে অসাধারণ জ্ঞান ও ক্ষমতা দিয়েছেন, তেমনি তাঁর প্রবর্তিত দ্বীন ও আদর্শকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত করা ও রাখার জন্য তাঁর উত্তরসূরী ওলামা-মাশাইখকেও তিনি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা এবং বিশেষ সাহায্য প্রদান করেছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলের ন্যায় আমাদের এ উপমহাদেশে এবং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশেও ক্রমান্বয়ে বহুবিধ বাতিলের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একইভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহক্রমে এ উপমহাদেশে যেসব প্রকৃত নায়েবে রসূল, দূরদর্শী এবং দ্বীন ও মাযহাবের অকৃত্রিম দরদী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার মহান শায়খ ওলী-ই কামিল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী, সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্ হলেন অন্যতম। তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত অসাধারণ জ্ঞান, বেলায়তের ক্ষমতা, অব্যর্থ দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে একদিকে সমসাময়িক সব বাতিলকে চিহ্ণিত করে সেগুলোর সাথে সফল মোকাবেলা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও কোথাও একই ধরনের কিংবা নতুন নতুন পথভ্রষ্টতা দেখা দিলে সেগুলোর বিরুদ্ধে অব্যর্থ মোকাবেলার স্থায়ী ব্যবস্থা করেছেন, অন্যদিকে এ উপমহাদেশে সিলসিলাহ্-এ আলিয়া ক্বাদেরিয়ার শিক্ষা ও রূহানী দীক্ষাদানের মাধ্যমে মানুষের আত্মশুদ্ধি ও সব বিপদাপদে খোদায়ী সাহায্যপ্রাপ্তির সুদূর প্রসারী ব্যবস্থা করে গেছেন। এ নিবন্ধে তাঁর গৃহীত সফল ও বরকতময় পদক্ষেপগুলোর সংক্ষেপে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
এটাও বিশ্ববাসীর সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর নুবূয়তী শক্তির সামনে যেকোন কুফরী ও তাগূতী শক্তি হার মানতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে তাঁদের পথ প্রদর্শন ও আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অগণিত সৌভাগ্যবান মানুষ সত্যের পথে এসেছে, দ্বীন- ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে উভয় জাহানের সাফল্য অর্জন করে ধন্য হয়েছে। সুতরাং আমাদের আক্বা ও মাওলা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী যিন্দেগীর প্রতিটি বিষয়ে এবং কথা, কাজ ও অনুমোদনে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্য সফলতাই প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরই আনুগত্য ও অনুসরণে অগণিত আউলিয়া-ই কেরাম একইভাবে এক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছেন।
এখন ক্বাদেরিয়া তরীক্বার মহান বুযুর্গ হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্র বেলায়তী শক্তি, দুরদর্শিতা ও অবদানগুলোর কথা আলোচনা করা যাক! তিনি একাধারে একজন সৈয়দ বংশীয় যুগশ্রেষ্ঠ সুন্নী আলিম-ই দ্বীন, মুর্শিদে কামিল, অকৃত্রিম খোদাপ্রেমিক ও আশেক্ব-ই রসূল, গণ-মানুষকে জান্নাতের পথে আনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আন্তরিক, সর্বোপরি একজন অসংখ্য কারামতসম্পন্ন ওলী-ই কামিল ছিলেন। এ কারণেই তিনি সমসাময়িক যাবতীয় বাতিলের সাথে সফল মোকাবেলা করে ইসলামের সঠিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অকল্পনীয়ভাবে সফল হয়েছিলেন।
শাহানশাহে সিরিকোটের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
তিনি ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ৩৭তম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর আসল নাম ‘আহমদ’। তাঁর নামের আগে ‘সৈয়্যদ’ শব্দটি বংশীয় উপাধি আর ‘শাহ্’ শব্দটি জাতিগত উপাধি হিসেবে সংযোজিত হয়। তাই তিনি সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি’ নামে সমধিক খ্যাত। ‘সিরিকোট’ তাঁর জন্ম ও বাসস্থান। তিনি খাঁটি সাইয়্যেদ বংশের এক প্রসিদ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সাইয়্যেদ সদর শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। অধিকাংশের মতে তিনি ১৮৫৭ ইংরেজি সালে জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সিরিকোট গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। তিনি অল্প বয়সে পবিত্র ক্বোরআন হিফয করেন। স্থানীয় বিদ্যাপীঠে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য হিন্দুস্থানে গমন করেন। ১২৯৭হি. মোতাবেক ১৮৮০খ্রিস্টাব্দে উচ্চতর ডিগ্রীর সর্বশেষ সনদ অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দির নব্বইর দশকে বিবাহ্ করেন। অতঃপর ব্যবসার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গমন করেন। সেখানে সূতা ব্যবসায় যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে চলে আসেন। দেশে এসে ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার মহান পীর, মা‘আরিফে লাদুনিয়ার প্রসবণ ও উলুমে ইলাহিয়ার ধারক হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহর বরকতময় হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। ১৯২০ ইংরেজি সালে আপন পীরের নির্দেশে প্রায় ৬৩ বছর বয়সে বার্মায় গমন করেন এবং ত্বরীক্বা-ই ক্বাদেরিয়া সম্প্রসারণের প্রয়াস পান। পরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ত্বরীকার প্রচার-প্রসারে বহুমুখী অবদান রাখতে সক্ষম হন। অবশেষে ১৯৬১ হিজরীতে ওফাত বরণ করেন।
বেলায়তের উচ্চাসন লাভ
বেলায়ত লাভের তিন পদ্ধতিঃ ১. মাতৃগর্ভ থেকে ওলী হয়ে জন্মগ্রহণ করা, ২. আল্লাহর কোন নেক বান্দার কৃপাদৃষ্টিতে বেলায়তপ্রাপ্ত হওয়া এবং ৩. রিয়াযত-মুজাহাদার মাধ্যমে বেলায়তের মর্যাদায় উপনীত হওয়া। সুতরাং প্রথমত, শাহানশাহে সিরিকোট বংশীয়ভাবে খাঁটি সাইয়্যেদ। দ্বিতীয়ত, তাঁর পীর-মুর্শিদ হলেন হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তৃতীয়ত, রিয়াযত-মুজাহাদায়ও তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি আপন মুর্শিদ কামিলের লঙ্গরখানা ও মাদরাসার হোস্টেলের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন খিদমতটি আনজাম দিয়েছিলেন দীর্ঘ দিন যাবৎ। তিনি নিজ বাড়ী সিরিকোটের পাহাড় হতে সারাদিন লাকড়ি সংগ্রহ করতেন, দিন শেষে তা আঠার মাইল দূরে অবস্থিত চৌহার শরীফে নিয়ে যেতেন। এর ফলে তাঁর হাতে ও ঘাড়ে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো, তার চিকিৎসা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত চলেছিলো। আর এই ক্ষত সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘‘ইয়ে মেরে বাবাজী কা মোহর হ্যায়।’ তারপর তিনি লোকালয় ছেড়ে বন-জঙ্গলে গিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগূল হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু অনুমতি চাইতে গেলে তাঁর মুর্শিদ হযরত চৌহরভী বলেছিলেন, ‘‘বন-জঙ্গলে কঠিন মুজাহাদার চেয়ে উত্তম ও সুন্নাত হলো মানুষের মধ্যে থেকে দ্বীনের খিদমত করা।’’ তারপর তিনি লাহোর শাহী জামে মসজিদের ইমামতি করার অনুমতি চাইলে হযরত চৌহরভী সেটারও অনুমতি দিলেন না। কারণ তাতে এক গূঢ় রহস্য নিহিত ছিলো। এরপর তিনি তাঁর মুর্শিদের নির্দেশে আরেক কঠিন রেয়াযতে ব্রতী হন। তা হচ্ছে স্বদেশ ছেড়ে সুদূর রেঙ্গুনে গিয়ে দ্বীনের খিদমত আনজাম দেওয়া।
শাহানশাহে সিরিকোটের মুর্শিদ হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী ছিলেন ‘গাউসুল আ’যম শাহানশাহে জীলানীর সিলসিলার এক মহান ওলী। তিনি তাঁর রূহানী দৃষ্টিতে দেখেছিলেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরতুল আল্লামা সিরিকোটির মাধ্যমে রেঙ্গুন ও চট্টগ্রামে এক যুগান্তকারী দ্বীনী খিদমত নেবেন। সুতরাং তিনি হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহকে রেঙ্গুন চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। সুতরাং তিনি বিগত ১৯২০ ইংরেজি সালে স্বদেশের মায়া ছেড়ে রেঙ্গুনে চলে যান। এভাবে তিনি বেলায়তের এক অতি উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত হন।
দ্বীন ও মাযহাবের বড় বড় খিদমত
এ ক্ষেত্রে শাহানশাহে সিরিকোটের মধ্যে বড় বড় দ্বীনী সংস্কারক, ইসলাম ও সুন্নিয়াতের মহান প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকারীর দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। যেই আদর্শ ও বেলায়তী ক্ষমতা বলে হযরত শাহানশাহে বাগদাদ সারা বিশ্বে ইসলামকে পুনর্জীবিত করেছেন, খাজা গরীব নাওয়ায ভারতে বোত-প্রতিমা ও অগ্নিপূজা ইত্যাদির স্থলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন, হযরত শাহ জালাল ইয়ামনী সিলেটী আলায়হির রাহমাহ বাংলাদেশের এক বিশাল অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছেন, ঠিক একইভাবে হযরত শাহানশাহে সিরিকোট বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের অনন্য খিদমত আনজাম দিয়েছেন। তাঁদের কাউকে এসব অবদান রাখার জন্য কোন রাজকীয় ক্ষমতা, বিশাল বিশাল জনবল, শক্তিশালী অস্ত্রসস্ত্র ব্যবহার করতে হয়নি; বরং তাঁদের আদর্শ চরিত্র, অসাধারণ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা ও সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ এবং সর্বোপরি অদম্য বেলায়তী ক্ষমতা দেখে অগণিত অসংখ্য মানুষ অনায়সে ইসলাম ও সুন্নিয়তকে গ্রহণ করেছিলো। এ সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে অকাট্য গ্রন্থ-পুস্তক এবং ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
এ নিবন্ধে শাহানশাহে সিরিকোটের কতিপয় ঐতিাহিসক অবদানের কথা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
এক. দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউন, মোম্বাসা ও জাঞ্জিবারের বিভিন্ন জনপদে শাহানমাহে সিরিকোটের হাতে অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। [সূত্র. ড. ইব্রাহীম এম. মাহদী লিখিত এ্যা শর্ট হিস্ট্রী অব ইসলাম ইন সাউথ আফ্রিকা]
দুই. ১৯১১ইংরেজি সালে তাঁর নিজের অর্জিত অর্থে আফ্রিকার প্রথম জামে মসজিদটি তাঁর হাতেই নির্মিত হয়। [সুত্র. প্রাগুক্ত]
তিন. ১৯০২ ইংরেজি সনে হরিপুর বাজারে প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল উলূম ইসলামিয়া রহমানিয়া’ হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর বরকতময় হাতেই বিশাল মারকায (কেন্দ্র) হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে।
চার. ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রেঙ্গুনে শুভ পদার্পন করেন। এখানে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ ২১-২২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি তৎকালীন বার্মায় হাজার হাজার অমুসলিমকে মুসলমান বানিয়েছেন এবং অসংখ্য বিপথগামী মুসলমানকে বানিয়েছেন সাচ্ছা (সুন্নী) আক্বীদার পরহেযগার বান্দা। [সূত্র. সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট, আঞ্জুমানে শূরা-ই রহমানিয়া, রেঙ্গুন, ৬ অক্টোবর, ১৯৩৫ইং]
পাঁচ. তিনি রেঙ্গুন গমন করে প্রথমে ক্যাম্পবেলপুরে মাওলানা সুলতানের মাদরাসায় এবং পরবর্তীতে রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙালী সুন্নী জামে মসজিদের খতীব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর তা’লীম তারবিয়াত এবং হিদায়তের ফলে অনেক সৌভাগ্যবান বান্দা ইনসান-ই কামিল, এমনকি ওলী-বুযুর্গে পরিণত হন।
ছয়. হযরত খাজা চৌহরভী নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁর লিখিত ৩০ পারা সম্বলিত দুরূদ শরীফ গ্রন্থ ‘মাজমূ‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই রসূল’ ছাপানোর কাজ এবং দারুল রহমানিয়া মাদরাসা পরিচালনার জন্য কোন বিহিত ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি রেঙ্গুনেই অবস্থান করেন। সুতরাং তিনি ১৬ বছর পর স্বদেশে যান। ইতোমধ্যে তিনি ১৯৩০ সনে এত বিশাল পরিসরের কিতাবটির রেঙ্গুন থেকেই প্রথম সংস্করণ প্রকাশের কাজ সুসম্পন্ন করেন। আর রহমানিয়া মাদরাসার দ্বিতল ভবন নির্মাণ করান। এমনকি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আবাসন এবং শিক্ষকদের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থাটাও তিনি রেঙ্গুন থেকে করেছেন।
সাত. আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা
১৯২৫ ইংরেজির ১৫ই ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুনের সুলে পেগোড়া সড়কের বাঙালী সুন্নী জামে মসজিদে বসে তাঁর বিশাল দ্বীনী মিশনে নিজের মুরীদরেকে কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমানে শূরা-ই রহমানিয়া’। এ আনজুমান ২৯ শে আগস্ট ১৯৩৭ ইংরেজি হতে প্রথমে রেঙ্গুনের চট্টগ্রাম শাখা হিসেবে এবং পরে ১৯৪২ ইংরেজি হতে কেন্দ্রীয় সংগঠনের ভূমিকা পালন করে চট্টগ্রামে। এটা এ নামে কাজ করে দীর্ঘ ৩০ বছর। পরে ২২ জানুয়ারী ১৯৫৪ ইংরেজি সনে ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ প্রতিষ্ঠা করা হয় নতুন মাদরাসা বাস্তবায়নের জন্য। এরপর এ দু’ আহ্জুমান যুক্ত হয়ে ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে (১৮ই মার্চ, ১৯৫৬ইং) এ নামে খ্যাত হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’। এ আনজুমানের অধীনে ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’সহ শতাধিক মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’ প্রতি বছর আয়োজিত হচ্ছে। মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আলমগীর খানকাহ্ শরীফসহ অগণিত খানক্বাহ্, মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’ দ্বীন ও মাযহাবের অসাধারণ খিদমত আনজাম দিচ্ছে। ‘আনজুমান রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রতি বছর অগণিত অতি জরুরী গ্রন্থ পুস্তক প্রকাশিত হচ্ছে।
আট. জামেয়া প্রতিষ্ঠা
হুযূর কেবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ সত্য প্রতিষ্ঠা ও বাতিল অপসারণের এক স্থায়ী ও যুগান্তকারী ব্যবস্থা করেছেন ‘জামেয়া’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষপট সম্পর্কে আজ সবাই জানে। বিগত ১৯৪৯ ইংরেজি সালের ডিসেম্বর মাস। মরহুম মাওলানা এজহার উদ্দীনসহ কতিপয় নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হুযূর ক্বেবলাকে তৈলারদ্বীপ, টইটং, পুঁইছুড়ি ও শেখেরখিল ইত্যাদি এলাকায় সফর করানোর উদ্দেশ্যে দাওয়াত করেন। শেখের খিলের বাসিন্দারা একদিন আসরের নামাযের পর হুযূর ক্বেবলার সফর উপলক্ষে এক ওয়াজ ও মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। হুযূর ক্বেবলাও ওই মাহফিলে সদয় উপস্থিত হলেন। মাহফিলের কয়েকটা বিষয় হুযূর ক্বেবলাকে দারুনভাবে ব্যথিত করলো। একটি হলো হুযূর ক্বেবলার পূর্বে একজন মৌলভী যথানিয়মে দুরূদ শরীফ ইত্যাদি ছাড়াই বক্তব্য শুরু করে দিলো। এরপর হুযূর ক্বেবলা যখন তাক্বরীর শুরু করলেন তখন তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে দুরূদ ও সালাম পড়ার নির্দেশ বিশিষ্ট আয়াত শরীফ ‘‘ইন্নাল্লা-হা ওয়ামালা-ইকাতাহু ইয়ূসাল্লূ-না আলান্নাবিয়্যি ইয়া-আইয়্যুহাল্লাযী-না আ-মানূ- সল্লূ- ‘আলায়হি ওয়াসাসাল্লিমূ- তাসলী-মা-’’ তিলাওয়াত করলেন। কিন্তু হুযূর ক্বেবলার সফরসঙ্গী ১৫/২০ জন ছাড়া কেউ দুরুদ শরীফ পড়লোনা।
আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশ অমান্য, দরূদ শরীফের মতো বরকতমন্ডিত ইবাদতের প্রতি অনীহা ও অবজ্ঞা ইত্যাদির মতো অশোভন আচরণ দেখে তা নিরবে সহ্য করা অন্য কারো দ্বারা সম্ভব হলেও আল্লাহ্র এক মহান ওলী, অকৃত্রিম আশেক্বে রসূলের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এ কথার বাস্তবতা মধ্যাহ্ণ সূর্যের ন্যায় প্রমাণিত হলো হুযূর ক্বেবলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ থেকে।
হুযূর কেবলা তাঁর বেলায়তী তীক্ষ্মদৃষ্টি দ্বারা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, এ দেশে ওহাবী মতবাদ অনুপ্রবেশ করে গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে; সুতরাং এর প্রতিরোধ-প্রতিকারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সুতরাং তিনি তখন থেকেই বাস্তব পদক্ষেপ নিলেন। মাগরিবের নামাযের সময় মাহফিল সমাপ্ত হলো। এরপর মাহফিলে উপস্থিত প্রায় সবাই চলে গেলো। কিন্তু হুযূর ক্বেবলা চুপচাপ বসে রইলেন। কারো সাথে কোন কথা বার্তা বললেন না। এশার নামায হুযূর ক্বেবলা মসজিদে আদায় করলেন। এরপর মসজিদে হুযূর ক্বেবলা তাঁর নূরানী তাক্বরীর শুরু করলেন। এ ওয়া’যে তিনি ওহাবীদের মুখোশ উন্মোচন করতে লাগলেন। দুশ্মনানে রসূলের অশোভন আচরণের ফলে জন্মানো মনের ক্ষোভ তার নূরানী যবান দিয়ে তাদের ‘ক্বোরআন-সুন্নাহ্ ভিত্তিক খন্ডন অগ্নি-স্পুলিঙ্গের ন্যায় বের হয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে শানিত তরবারির রূপ নিছিলো। ওহাবীরা নবীর দুরূদ শরীফ পড়লো না। এরপর থেকেই এ দেশে সুন্নিয়াতের আন্দোলন নব উদ্যমে আরম্ভ হলো।
রাতে হুযূর ক্বেবলা খানাপিনা গ্রহণ করেননি। সুতরাং সফরসঙ্গীদের কারো পানাহারও হয়নি। সফর শেষ করে শহরে ফিরে এসে শুরু হলো ওহাবীদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ঈমান বাঁচানোর লড়াই। সুতরাং তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিলেন। সম্ভবতঃ তখনকার সময়েরই হুযূর ক্বেবলার এ যুগান্তকারী নির্দেশ ‘‘কাম করো, ইসলামকো বাচাও, দ্বীন কো বাচাও, সাচ্ছা আলিম তৈয়ার করো।’’ (কাজ করো, ইসলামকে রক্ষা করো, দ্বীনকে রক্ষা করো, সাচ্চা আলিম তৈরী কর।) তারপর মাদরাসার জন্য জমি খোঁজার নির্দেশ দিলেন। হুযূর ক্বেবলা যে বৈশিষ্ট্যাদির জমি চেয়েছিলেন তা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেলো নাজির পাড়ায়, বর্তমানে যেখানে ‘জামেয়া’ সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। আলহামদুলিল্লাহ! আজ এ জামেয়া উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্নী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। এ জামেয়া এখন ‘কিশ্তী-ই নূহ’ (আলায়হিস্ সালাম), জান্নাত-নিশান (বেহেশতসদৃশ)। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ মাদরাসার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁর ‘দিওয়ান-ই আযীয’ কাব্য গ্রন্থে। তাছাড়া, হুযূর ক্বেবলা এ মাদরাসাকে মানুষের যাবতীয় মুশকিল আসান হওয়ার মাধ্যম বলে আখ্যায়িত করে এর গুরুত্বকে আরো বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন মাদরাসার জন্য মান্নত করো, মান্নতপূর্ণ হলেই মান্নতটুকু পূরণ করো।’’ আলহামদুলিল্লাহ্! এ পর্যন্ত কারো মান্নত পূর্ণ হয়নি এমন শোনা যায়নি। বলাবাহুল্য, হুযূর ক্বেবলার দো‘আর বরকতে প্রতি বছর এ মাদরাসা থেকে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ সুন্নী ওলামা তৈরী হয়ে বের হচ্ছে।
নয়. তিনি এ উপমহাদেশে কাদেরিয়া তরীক্বার প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন। তাঁর হাতে এবং তাঁর খলীফা ও উত্তরসূরী হযরতগণের হাতে ক্বাদেরিয়া তরীক্বার বায়‘আত গ্রহণ করে অসংখ্য মানুষের ঈমান-আক্বিদার সংরক্ষণ হয়েছে ও হচ্ছে। সর্বোপরি অগণিত মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে তাঁরা সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষে পরিণত হচ্ছে। ফলে, তাঁরা উভয় জাহানে সাফল্যমন্ডিত হচ্ছেন।
দশ. মসলকে আ’লা হযরত প্রতিষ্ঠা
মসলকে আ’লা হযরত হচ্ছে ইসলামেরই প্রকৃত রূপরেখার নাম। ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, সংক্ষেপে সুন্নী মতাদর্শ। ইসলামী বিশ্বে যখন একদিকে অইসলামী বিশ্বাস ও কর্মকান্ডকে বিভিন্নভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার পাঁয়তারা চলছিলো, অন্যদিকে ওহাবী, মওদূদী, আহলে হাদীস, চাকড়ালভী (আহলে ক্বোরআন), শিয়া, রাফেযী ইত্যাদি সম্প্রদায় যখন তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা ও কর্মকান্ডকে ইসলামী আক্বীদা ও কর্মকান্ডরূপে এমনভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছিলো, ঠিক তখনই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ (সুন্নী মতাদর্শ)-এর আসল রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী আলায়হির রাহমাহ্। আর সেটারই অপর নাম ‘মসলকে আ’লা হযরত’ বা আ’লা হযরতের অনুসৃত পথ। উপমহাদেশে অনেকে মাদরাসা করেছেন, কিন্তু ফলশ্রুতিতে ইসলামের প্রকৃত আদর্শের আলিম সেগুলোর মধ্যে অনেক কম সংখ্যক মাদরাসা থেকে বের হচ্ছেন; বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ‘আলিম-ই সূ’ (মন্দ আলিম) বের হয়ে ইসলামকে করছে বদনাম, সমাজকে করছে কলুষিত। তাই, হুযূর ক্বেবলা যেই জামেয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটাকে মসলকে আ’লা হযরতের ভিত্তিতে পরিচালনার নির্দেশ দেন। এর ফলে এ দেশ এমনকি উপমহাদেশের মানুষ একদিকে আ’লা হযরতকে চিনতে পারেন এবং তাঁর মসলকের মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত আদর্শের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছেন।
এগার. শাহানশাহে সিরিকোট তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী ও বা-কারামাত বুযুর্গ খলীফা রেখে গেছেন। তাঁর প্রধান খলীফা হুযূর ক্বেবলা হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তাঁর সম্পর্কে হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট বলেছেন, ‘‘আমি রোযা রেখেছি, তৈয়্যব ঈদ উদযাপন করবে। তৈয়্যব মাদারযাদ ওলী।’’ (মায়ের গর্ভ শরীফ থেকে ওলী হয়ে এসেছেন) তাছাড়া, তিনি ছিলেন দাদাপীর হযরত চৌহরভী ও আপন পিতা হুযূরের চোখের মণি। তাঁর উত্তরসূরী প্রধান খলীফা আমাদের বর্তমান হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মুদ্দাযিল্লুহুল আলীও রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে মাক্ববূল। বিগত ১৯৫০/৫১ ইংরেজি সালে শাহানশাহে সিরিকোট হজ্জে তাশরীফ নিয়ে গেলে তিনি যখন তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রওযা-ই পাকে বিদায়ী সালাম পেশ করছিলেন তখন রওযা-ই পাক থেকে আগামীবার হজ্জে আসার সময় তাঁর নাতি সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেবকে সাথে নিয়ে আসার সদয় নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সুতরাং তিনি আপন ওই নাতি সাবালক হলে বিগত ১৯৫৮ সালে তাঁকে সাথে নিয়ে হজ্জে গিয়েছিলেন এবং প্রিয় নবীর রওযা-ই পাকে সালাম আরয করেন। ওই হজ্জেই আরাফাতের ময়দানে তাঁকে আপন হাতে হাত রেখে বায়‘আত করান এবং ফুয়ূযাতে ভরপুর করে দিলেন। হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ মুদ্দাযিল্লহুল আলী সম্পর্কেও হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আর হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহও একবার বলেছিলেন সাবের শাহকে তোমরা মা’মূলী ব্যক্তিত্ব মনে করোনা। আলহামদুলিল্লাহ্ এ সব বরকতমন্ডিত ঘটনা ও ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবতা বিশ্ববাসী দেখেছে ও দেখে যাচ্ছে।
আরো উল্লেখ্য যে, শাহানশাহে সিরিকোট এমন বরকতময় সান্নিধ্য, শিক্ষা ও তরীকা দিয়ে গেছেন, যেগুলো যাঁরা গণীমত মনে করে সেগুলোর প্রতি নিষ্ঠার সাথে গুরুত্বারোপ করেছেন, তাঁরা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রিয় হয়েছেন ও হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের দুনিয়াবী উন্নতির কথাতো সর্বত্র প্রসিদ্ধ আছেই। তাঁদের মধ্যে আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী, আলহাজ্ব ওয়াজের আলী সওদাগর, আলহাজ্ব ডা. টি. হোসেন, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান সওদাগর, আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, আলহাজ্ব মাস্টার আবদুল জলীল, আলহাজ্ব সূফী আবদুল গফূর, শায়খ আফতাব উদ্দীন চৌধুরী প্রমুখের নাম শীর্ষে। তাঁদের মধ্যে অনেকে সরাসরি আল্লাহর হাবীবের দীদার (সাক্ষাৎ) পেয়েছেন। এভাবে এ তরীক্বতে নিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অগণিত মানুষ ধন্য হয়েছে এবং আগামীতেও হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাই, এ ফিতনার যুগে শাহানশাহে সিরিকোটের বরকতমন্ডিত এ মিশনের সাথে সম্পৃক্ত হবার বিকল্প পথ আছে বলে মনে হয় না।
তাছাড়া হযরত শাহানশাহে সিরিকোট যে বহু উঁচুস্তরের ওলী ছিলেন তা তাঁর অগণিত কারামত দ্বারাও প্রমাণিত হয়। তাই এ নিবন্ধে কয়েকটা কারামত উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
এক. হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ অসংখ্য কারামতের আধার ছিলেন। তন্মধ্যে একটি হলো তাঁর মধ্যে হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম-এর প্রভাব ছিলো। তিনি যখন কোন ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন যে কারো দ্বারা তা বাস্তবায়ন করতেন। রেঙ্গুনে অবস্থানকালে বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত ছিলেন মরহুম ফজলুর রহমান। একদিন সকালে তিনি বাজার করার জন্য হুযূর ক্বেবলার নিকট টাকা চাইলেন। হুযূর ক্বেবলা অপেক্ষা করতে বললেন। হুযূর ক্বেবলা দোতলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেলো। বাবুর্চি ফজলুর রহমানের অপেক্ষা ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। এক সময় দেখলেন এক অতি সুন্দর নূরানী চেহারাধারী আগন্তুক এসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর লোকটি বিদায় নিলে হুযূর ক্বেবলা বাবুর্চিকে ডাকলেন এবং কিছু টাকা দিয়ে বাজার যেতে বললেন। বাবুর্চিও আগন্তুক লোকটার পরিচয় জানার জন্য একটি বাহানা করলেন। তিনি বললেন, ‘‘আজ বাজারে যাবো না, প্রয়োজনে ভূখা থাকবো, যতক্ষণ না লোকটার পরিচয় বলেন।’’ হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘আমার নিকট টাকা ছিলোনা। তাই তোমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে হযরত খিযির আলায়হিস্ সালাম এসে কিছু টাকা দিয়ে গেলেন। বাবুর্চি ফজলুর রহমান খুশী মনে বাজারে গেলেন।
দুই. রেঙ্গুনের নামকরা মদ্যপ দুশ্চরিত্র কাকা সরদার হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের নেক নজরে একজন কামিল ইনসানে পরিণত হয়েছিলেন। একদিন ভোরে হুযূর ক্বেবলার নিষ্ঠাবান মুরীদ ও খলীফা সূফী আবদুল গফুর হুযূর ক্বেবলার পেছনে ফজরের নামায পড়ার জন্য যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কাকা সরদার সামনে পড়লো আর বললো, ‘‘সূফী সাহেব, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘নামায পড়তে মসজিদে যাচ্ছি।’’ কাকা সর্দার বললো, ‘‘সেখানে কি পাওয়া যায়?’’ সূফী সাহেব বলে ফেললেন, ‘‘সেখানে জান্নাত পাওয়া যায়।’’ সর্দার বললো, ‘‘আমারও জান্নাত চাই। আমিও তোমার সাথে যাবো।’’ সুতরাং সে তাই করলো।
মুসল্লীরা সূফী সাহেবের সাথে কাকা সর্দারকে আসতে দেখে প্রমাদ গুণতে লাগলেন। জানিনা আজ কি ঘটে! সর্দার মসজিদের বাইরে বসে রইলো। নামায সমাপ্ত করে হুযূর ক্বেবলা মুসল্লীদের নিকট বয়ান করার জন্য তাশরীফ আনলে কাকা সরদারকে দেখলেন। তাকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাস করলেন। কাকা বললো, সূফী সাহেব বলেছেন ‘‘এখানে জান্নাত পাওয়া যায়। আমারও জান্নাত চাই।’’ হুযূর বললেন, ‘‘ঠিক আছে। ওযূ করে এখানে বসে যাও। প্রথমে বায়‘আত করে নাও। তারপর জান্নাত মিলবে।’’
সুবহানাল্লাহ্! একথা শুনে সর্দার বললো, ‘‘আমার একটা শর্ত আছে, ‘আমি শরাবখানায়ও যাবো, বেশ্যালয়েও যাবো’।’’ আমার শর্ত মানলে আমি বায়‘আত করে নেবো।’’ হুযূর বললেন, ‘‘ঠিক আছে। আমি তোমার শর্ত মেনে নিলাম; কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে। সেটাও তোমাকে মানতে হবে।’’ সর্দার ভাবলো, হুযূর আর কি শর্ত দেবেন। আমিও তা মেনে নেবো বৈ-কি?’’ আর বললো, ‘‘ঠিক আছে। বলুন, আপনার কি শর্ত?’’ হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘শূয়রের বাচ্ছা দেখলে ওই শরাব পান করবে না। আর আমার সামনে দিয়ে বেশ্যালয়ে যাবে না।’’ সে ভাবলো, ‘‘শরাবের মধ্যে শূয়রের বাচ্চা আসবে কোত্থেকে?’’ আর হুযূর থাকবেন মসজিদে। আমি রাতের বেলায় বেশ্যালয়ে যাবো। হুযূর কিভাবে দেখবেন? সে বললো, ‘‘হ্যাঁ পাক্কা ওয়াদা! আমি শর্ত দু’টি মেনে নিলাম।’’
হুযূর তাঁকে বায়‘আত করালেন আর তার হিদায়তপ্রাপ্তির জন্য দো‘আ করলেন। সর্দার বিদায় হয়ে গেলো। সবার মনে প্রশ্ন হুযূর এটা কি করলেন। এমন নামকরা গুন্ডা, মদ্যপ ও রন্ডিবাজকে এভাবে বায়‘আত করালেন! দেখা যাক, গাউসে যমান কি করতে পারেন? যথারীতি সন্ধ্যায় সর্দার শরাব খানায় গিয়ে সাগ্রহে শরাবের অর্ডার দিলো। মদের বোতল আর গ্লাস পরিবেশন করা হলো। সর্দার গ্লাসে মদ ঢেলে পান করার জন্য উদ্যত হলে দেখতে পেলো শরাবের গ্লাসে শূয়রের বাচ্চা ছুটাছুটি করছে। সর্দার তা ছুঁড়ে মারলো। তারপর গ্লাসের পর গ্লাস আনা হলো; কিন্তু সব ক’টিতে একই অবস্থা। সর্দার শরাব পান না করে এবার বেশ্যালয়ের দিকে রওনা হলো। এখানে এসে দেখতে পেলো বেশ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে হুযূর ক্বেবলা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর এ পথ ও পথে গিয়েও দেখতে পায় সব ক’টি পথে ও রাস্তার মাথায় হুযূর ক্বেবলা লাঠি হাতে দন্ডায়মান। হতাশ, নিরুপায় হয়ে মসজিদের দিকে এসে দেখতে পেলো, হুযূর ক্বেবলা নামাযের মুসল্লায় বসা আছেন। এভাবে ভোর হয়ে গেলো। ভোরে সর্দার উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে মসজিদে গিয়ে হাযির হলো। নামায শেষে হুযূর ক্বেবলা বললেন, ‘‘সর্দার তোমার কি অবস্থা?’’ সর্দার বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে করজোড় ক্ষমা চাইলো আর খাঁটি নিয়্যতে তাওবা করে নিলো। এ-ই কাকা সর্দার রেঙ্গুনে হুযূর ক্বেবলার প্রতিনিধি হয়ে দ্বীন ও মাযহাবের অনেক খিদমত আঞ্জাম দেন। এভাবে অনেক কারামত হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট থেকে প্রকাশ পেয়েছিলো। হুযূর ক্বেবলার জীবনীগ্রন্থ প্রণয়ন এখন সমাপ্তির পথে। তাতে অন্যান্য কারামত ও অবদান সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। মোটকথা, তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত প্রজ্ঞা, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রকৃত ভালবাসা এবং অসাধারণ বেলায়তী শক্তি দ্বারাই দ্বীন, মাযহাব এবং হিদায়তের ক্ষেত্রে অসাধারণ খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর সান্নিধ্য ও বরকত পেয়ে আজ অগণিত ভাগ্যবান মানুষ ধন্য।