হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ (রঃ:) এর ঐশীশক্তি এবং ইসলাম’র প্রচার | Biography of Hazrat Khwaja Garibe Newaz (RA)

Join Telegram for More Books

 

আতায়ে রসূল, খাজায়ে খাজাগান, সুলতানে হিন্দুস্থান, গরীবে নাওয়াজ হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি আজমিরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৫৩৬ হিজরি মতান্তরে ৫৩৭ হিজরি সনে ১৪ রজব সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩৩ হিজরি মতান্তর ৬৩৪ হিজরি মুতাবিক ৬ রজব সোমবার ওফাত বরণ করেন। খাজা গরিবে নাওয়াজ রাহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বুযুর্গ পিতা হযরত খাজা সাইয়্যিদ গিয়াসুদ্দীন আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং মহীয়সী মাতা হযরত সাইয়্যিদা উম্মুল ওয়ারা রাহমতুল্লাহি আলাইহা। খাজা গরীবে নাওয়াজ রহমতুল্লাাহি আলাইহি-এর পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়ে নবীকুল সরদার হুজুর সৈয়্যদুনা রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পবিত্র বংশীয় উত্তরাধিকারী তথা সৈয়দ বংশদ্ভূত ছিলেন। এককথায় তিনি ছিলেন, আহলে বায়তে রাসুলের অন্যতম সমুজ্জ্বল নক্ষত্র।

হজরতের বয়স যখন ১৫ বছর তখনই পিতা-মাতা উভয়ই ইন্তেকাল করেন। পিতৃ-মাতৃহারা এ শিশুর কোন পরামাত্মীয় ছিল না, সম্পদ বলতে ছিল পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি যাঁতি ও আঙ্গুর ফলের বাগান। গরীবে নাওয়াজের জীবনী ও ইতিহাসের বর্ণনাসূত্রে দেখা যায়, সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নাওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রাহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত ফলের বাগানে কাজ করছিলেন; এমন সময় উক্ত বাগানে তাশরীফ আনলেন মজ্জুব অলি হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। এসময় ইব্রাহিম কান্দুজী বাগানের একপাশে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলেন। গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষয়টি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে হযরত ইবরাহীম কান্দুজী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে গিয়ে তাঁর খিদমতে কিছু আঙ্গুর ফল পেশ করলেন। ফল খাওয়া শেষ হলে হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী রাহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বরকতময় থলি থেকে কিছু খাদ্য (গমের রুটি) বের করে কিছু অংশ নিজ দাঁতে চিবিয়ে খেয়ে বাকিটা গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে খেতে দিলেন।

হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী উক্ত রুটি খাওয়ার পর তাঁর মধ্যে ভাবান্তর (হাল) সৃষ্টি হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে জগৎ সংসার বিমূখ হয়ে নিজের পিতৃসম্পদ যাঁতি ও ফলের বাগান বিক্রি করে দিয়ে ইল্মে শরীয়ত, হাক্বিকত ও মারিফাত হাসিলের জন্য সফরে বের হয়ে পড়েন। প্রথমে বুখারা গিয়ে সাড়ে সাত বছর ইলমে কুরআন, তাফসির, হাদিস, ফিক্বাহসহ নানা বিষয়ে পূর্ণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। অতঃপর ইল্মে তাসাউফের গভীর নির্যাস হাসিলের লক্ষ্যে শায়খ তথা পীর-মুর্শিদ তালাশ করতে লাগলেন এবং তৎকালীন জামানার শ্রেষ্ঠ বুযূর্গ ও সাধক হযরত উছমান হারুনী (হারওয়ানি) রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দস্ত মোবারকে বাইয়াত গ্রহণ করে প্রায় একুশ বছর কঠোর রিয়াযত-মুরাকাবা ও মুশাহাদার মাধ্যমে ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা হাসিল করেন। এর আগে শায়খ হযরত উছমান হারুনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একদিন তাঁকে (খাজা গরীবে নাওয়াজকে) বললেন, “হে মুঈনুদ্দীন! চলুন, আপনাকে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছাহেবে লাওলাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নিকট সোপর্দ করে দেব।”

একথা বলে হযরত উছমান হারুনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গরীবে নাওয়াজকে সাথে নিয়ে হজে রওয়ানা হন। হজ্ব সম্পন্ন অর্থাৎ কা’বা শরীফ তাওয়াফ ও যিয়ারত সম্পাদন করার পর হযরত উছমান হারুনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন,“হে আল্লাহ পাক! মুঈনুদ্দীনকে আপনার নিকট সোপর্দ করে দিলাম, আপনি তাঁকে কবুল করুন।” সাথে সাথে এলহাম হলো (মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অদৃশ্য আওয়াজ)- “হে উছমান হারুনী! আমি মুঈনুদ্দীনকে কবুল করে নিলাম।”

অতঃপর মদিনা শরীফে হুজুর রাহমাতুল্লিল আলামিন সাইয়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজা শরীফ যিয়ারত করলেন। এসময় হযরত উছমান হারুনী খাজা মঈনুদ্দিনকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে মুঈনুদ্দীন! আপনি সালাম পেশ করুন।” তিনি সালাম দিলেন- “আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!” সাথে সাথে রওজা মোবারক হতে জবাব আসলো- “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ইয়া কুতুবুল হিন্দ।” অর্থাৎ হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালামের জবাবের সাথে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর কার্যক্রমসহ তার বেলায়তের পদমর্যাদা বা উপাধিও দিয়ে দিলেন- “কুতুবুল হিন্দ” বা হিন্দুস্থানের কুতুব বলে। নবুয়াতি মুজেজা আর বেলায়তি কারামাতের সাজুয্যে প্রাপ্ত নিয়ামতে ওজমাতে মঈনুদ্দিন হয়ে গেলেন আতায়ে রাসুল, গরিবে নাওয়াজ, সুলতানুল হিন্দ। রওজা শরীফ থেকে সরাসরি ফয়েজ আর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে আর দেরি করলেন না খাজা মঈনুদ্দীন; এরপর বেলায়তের স¤্রাট গাউসে পাক হজরত সৈয়দুনা আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দেশ বাগদাদ হয়ে হিন্দুস্তানে চলে আসেন।

তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে হিকমতপূর্ণ তাজদীদের মাধ্যমে হিন্দুস্তান থেকে পৌত্তলিকতার যাবতীয় শিরক, কুফর, বিদয়াত ও অপসংস্কৃতি দূরীভুত করে লক্ষ লক্ষ অমুসলিমকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। যাদের মাধ্যমে হিন্দুস্তানে একটি শান্তিময়, সাম্য ও সম্প্রীতির সমাজ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খাজা গরিবে নাওয়াজের এ দাওয়াতি কার্যক্রম মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদা রিদওয়ানুল্লাহি তা’আলা আলাইহি আজমাঈনের পরে সবচেয়ে বড় ও কঠিনতম দাওয়াতি কার্যক্রম ছিল। কারণ যে দেশে গরীবে নাওয়াজের উপর তাবলীগে দ্বীনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেই দেশটিই পুরোপুরিভাবে পৌত্তলিকতা ও অপসংস্কৃতিতে ভরপুর ছিল। এখানে আরবীয় পুরনো প্রথার মতই সনাতন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে একটি নতুন সমাজ ও সভ্যতার গোড়া পত্তন করা সহজ বিষয় ছিল না। কিন্ত খাজা গরীবে নাওয়াজ রাসূলে পাকের বিশেষ করুণা ও মহান রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত দয়া ও মেহেরবাণীতে সেই কঠিনকে সহজে জয় করে নেন বিশেষ হিকমত আর মরমি ধারার এক ঐশী সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে।

সুফিয়ায়ে কেরামের ভাষ্যে, গরীবে নাওয়াজ, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এত বিরাট সফলতা অর্জনের পেছনে একমাত্র শক্তি আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি আপন পীর ও মুর্শিদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও কঠোর রিয়াজত।

খাজা গরীবে নাওয়াজের উপর রচিত বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থ পাঠান্তে দেখা যায়, গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন এ ক্ষণকালীন জগৎ থেকে বিদায় নেয়ার সময় হলো তখন তাঁর প্রধান খলীফা হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে ডেকে বললেন, “হে বখতিয়ার কাকী! আমার সময় শেষ, আমার নিকট আল্লাহ পাকের যা নিয়ামত রয়েছে, তা আমি আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি, আপনি তার হক্ব আদায় করবেন। আর আপনি দিল্লি চলে যান, আপনার হিদায়তের বা দ্বীন প্রচারের স্থান হলো দিল্লি।” হযরত বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুজুর শায়খ (রাহ.)-এর নির্দেশ পালনার্থে আমি দিল্লি চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে বিশ দিন পর আমি সংবাদ পেলাম আমার মহাসম্মানিত পীর-মুরশিদ, শায়খ, চিশতিয়া তরিকতের সম্রাট গরীবে নাওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ জগৎ থেকে পর্দা করেছেন। এ খবর শুনে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, চোখের জল নিমিষে গড়িয়ে পড়ল। ইতোমধ্যে আছরের সময় আসন্ন। আমি আছর নামায পড়ে জায়নামাজে বসা ছিলাম। এমন সময় আমার তন্দ্রা এসে গেল, আমি দেখতে পেলাম, আমার মহামান্য শায়খ, মুর্শিদ আমার সম্মুখে উপস্থিত। আমি মহামান্য শায়খকে দেখে সালাম দিলাম ও কদমবুছী করলাম। অতঃপর আরজ করলাম, “হে আমার শায়খ! আপনি আল্লাহ পাক ও উনার রসূল হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেযামন্দির জন্য ৯৭ বছর ব্যয় করেছেন। মহান আল্লাহ পাক আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন? জবাবে গরীবে নাওয়াজ (রাহ.)বললেন, “হে আমার প্রিয় বখতিয়ার কাকী! প্রথমত মহান আল্লাহ পাক আমাকে ক্ষমা করেছেন। দ্বিতীয়ত যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব (দ.) এর কাছে সবচেয়ে মকবুল, তাঁরা আরশের অধিবাসী হবেন। অর্থাৎ তাঁরা সর্বদা আল্লাহ পাকের দীদারে মশগুল থাকবেন। মহান আল্লাহ পাক দয়া করে আমাকে সেই আরশের অধিবাসী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ আমি সর্বদা আল্লাহতা’আলার দীদারে মশগুল আছি।”

গরীবে নাওয়াজের জীবনী গ্রন্থ লেখকদের মধ্যে অনেকেই নিন্মের ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন, তাতে বলা হয়, খাজা গরিবে নাওয়াজ ছিলেন, পরিপূর্ণ আখলাকে নবীর প্রতিবিম্ব। তাঁর কাছ থেকে সুন্নতি জীবন বৈ অন্য কিছু কোন সময় প্রকাশ পায় নি। ইশ্কে রাসূল ছিল তাঁর ঈমানের বলিষ্ঠ শক্তি। গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বয়স যখন নব্বই বছর তখন তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দিদার লাভ করলেন। যখন বিশেষ সাক্ষাৎ বা দিদারে মুস্তফা লাভ করলেন তখন রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন, “হে মুঈনুদ্দীন! (মুঈনুদ্দীন অর্থ- দ্বীনের সাহায্যকারী)! আপনি সত্যিই আমার দ্বীনের সাহায্যকারী, আপনি আমার সব সুন্নতই পালন করেছেন, তবে একটি সুন্নত এখনো বাকি রয়ে গেল কেন?”

গরীবে নাওয়াজ এ কথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন, মন ভারি হয়ে গেল। সর্বশেষ তিনি বুঝতে পারলেন, আল্লাহ-রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনের খিদমতে ব্যস্ত থাকার কারণে তখনও বিবাহ করার সুযোগ হয়নি তাঁর। এরপর তিনি নব্বই বছর বয়সে পর পর দু’টি বিবাহ করে এ সুন্নাতও আদায় করলেন।

একথা সত্য যে, বিশ্বের কামেল অলিদের প্রত্যেকেই আল্লাহর হাবিবের মাহবুব। মাহবুবে খোদা হাবিবে মুস্তফা ছাড়া আল্লাহর নবীর দু’জন উম্মত ও ইশ্কে রাসূলে মতোয়ারা মহান সাধক পৃথিবীতে হাবীবুল্লাহ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। একজন হলেন হযরত যুননূন মিছরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। আর দ্বিতীয়জন হলেন সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। এ মহান দুই সাধকের ওফাতের পর তাদের কপালে কুদরতীভাবে সোনালি অক্ষরে লিখিত হয়েছিল- ‘হা-যা হাবিবুল্লাহ, মাতা ফী হুব্বিল্লাহ’ অর্থাৎ তিনি আল্লাহর হাবিব, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মুহব্বতেই তিনি বিদায় গ্রহণ করেছেন।

উল্লেখ্য যে, এই মহান সাধকের প্রতিষ্ঠিত তরিকার নাম – “চিশতিয়া তরিকা” অর্থাৎ তিনিই এ তরিকার ইমাম। এ তরিকা সম্পর্কেও রয়েছে বিশেষ সুসংবাদ। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এখানে আর বিবরণ দেয়া যাচ্ছেনা। প্রসঙ্গত আরো দু’একটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব।

রাওজায়ে আকদাস থেকে হায়াতুন্নবী রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে খাজা গরিবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ৪০ জন সঙ্গীসহ হিন্দুস্থানে আগমন করেন। এ সময়ে হিন্দুস্থান ছিলো পৌত্তলিকতায় ভরপুর। রাজন্যবর্গরাও ছিল অধিকতর স্বৈরাচারী, অমানবিক ও জালেম। পৌত্তলিকতায় বিশ্ববাসী ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিলো একেবারেই নগণ্য। গরীবে নাওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করে প্রথমে লাহোরে হযরত দাতা গঞ্জেবখশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাজার শরীফে চল্লিশ দিন অবস্থান করেন (চিল্লার মাধ্যমে মোরাকাবা ও মুশাহিদা করেন)। সেখান থেকে সরাসরি তিনি দিল্লিতে গমন করেন। মূলত এখান থেকে তিনি হিদায়তের কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর এ দাওয়াতি কার্যক্রম ছিল ঐশী তাওয়াজ্জুপ্রসূত। ফলে নিম্ন ও মধ্যবর্ণের পৌত্তলিকদের অনেকেই তাঁর কথা, আচর-আচরণ ও রুহানিয়ত দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু তাদের জন্য পরিবেশগত কারণে ইসলাম গ্রহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। পৌত্তলিকদের মধ্যে যারা রক্ষণশীল তথা গোঁড়াশ্রেণির তারা এবং ক্ষমতাশীল প্রভাবশালী কিছু লোক খাজা গরীবে নাওয়াজের এ শান্তি মিশনকে সহজে গ্রহণ করতে পারে নি। ফলে তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। খাজা গরীবে নাওয়াজকে হত্যা করার পরিকল্পনাও তারা নিয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একদিন পৌত্তলিকদের মধ্য থেকে একজন শক্তিশালী যুবক স্বশস্ত্র অবস্থায় কৌশলে খাজা গরীবে নাওয়াজের মজলিসে প্রবেশ করে, কিন্তু গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ঐ যুবককে দেখে বললেন, “চুপ চাপ আছ কেন?” নিজের কাজ সমাধা কর! সময় নষ্ট করে কি লাভ? “খাজা গরীবে নাওয়াজের এ ধরণের কারামাত ও রুহানিয়ত অবস্থা দেখে হত্যা করতে আসা যুবকটির সব উলট পালট হয়ে গেল। সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গরীবে নাওয়াজের কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলাম কবুল করল। সাথে সাথে তরিকতের দীক্ষা নিয়ে গরীবে নাওয়াজের ভাগ্যবান সহচরে পরিনত হল। এ ঘটনা মূর্তি পুজারীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ার পর দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এসময় ভারতীয় পৌত্তলিক রাজাদের মধ্যে পৃথ্বীরাজই ছিল শক্তিশালী এবং তার রাজধানী ছিল আজমিরে। গরীবে নাওয়াজ এবার তাঁর জন্য আদিষ্ট স্থান আজমীরের উদ্যেশ্যে বের হন। খাজা সনজরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি দিল্লি হতে আজমীরে এসেই বর্তমান মাজার সংলগ্ন জায়গায় আস্তানা গড়েন। এরপর রাজা পৃথ্বীরাজের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান। কিন্তু গরীবে নাওয়াজের দাওয়াত প্রত্যাখান করে তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। খাজা আজমিরীকে এ এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় সব অত্যাচার শুরু করেন। একসময় আজমীর সংলগ্ন আনাসাগরের পানি ব্যবহার করতে নিষেধ করলো এবং খাজা গরীবে নাওয়াজ ও তাঁর সহযোগিরা কেউ যেন পানি নিতে না পারে সেই জন্য কঠোর প্রতিরক্ষাবেধ রচনা করল। কিন্তু তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে কৌশলে মাত্র এক বদনা পানি নিলেন এবং তাতে ওই আনাসাগর দীঘীর সমস্ত পানি নয় শুধু আজমীর শরীফের আশেপাশে সকল পুকুর, জলাশয়, কুপের পানি, সন্তানের মায়ের দুধ ও শুকিয়ে যায়। এরপর আজমীরের লোকজন হজরতের কাছে ক্ষমা চাইলে আবারও আগের মত আনাসাগরসহ সব কুপ, জলাশয় ও পুকুর পানিতে ভরপুর হয়ে যায়। এটি মূলতঃ খাজা গরীবে নাওয়াজের কারামতের বহিঃপ্রকাশ। এঘটনার পর আজমীর ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে দলে দলে লোক এসে ইসলাম কবুল করতে লাগলেন। কিন্তু পৃথ্বীরাজ তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গরীবে নাওয়াজের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। গরীবে নাওয়াজের কারামাতের মোকাবেলায় সে তার বড় বড় দৈত্য দিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করা শুরু করলো। কিন্তু গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ন্যূনতম ক্ষতি করতে পারলো না। প্রতিটি পাথর গরীবে নাওয়াজের আস্তানায় পড়ার আগেই উল্টো নিক্ষেপকারী দৈত্য-যাদুগরদের আঘাত করত। এর পর হিন্দুস্থানের সেরা যাদুকর পৃথ্বীরাজের ভাই জয়পাল যোগীকে ডাকলো। কিন্তু যাদুকর জয়পালও তার সকল চেষ্টা প্রয়োগ করে ব্যর্থ হলো। তখন জয়পালের এ বোধোদয় হলো যে গরীবে নাওয়াজ ¯্রষ্টাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে যা করেছেন তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। জয়পাল পরাজয় মেনে নিয়ে একদিন গরীবে নাওয়াজের দরবারে এসে হজরতের দস্তমোবারকে হাত রেখে পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করেন। একই সাথে বায়াত গ্রহণ করে খাজা গরীবে নাওয়াজের কাছে বিনয়ের সাথে দীর্ঘজীবন ও আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকার আরজ করলেন। গরীবে নাওয়াজ মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সেই আশা পূর্ণ করলেন। ইসলাম গ্রহণের পর জয়পালের নামকরণ করা হয় আবদুল্লাহ। ভারতের মধ্যপ্রদেশের কুরুপান্ডবে অবস্থিত একটা পাহাড়ি জঙ্গল যেটা হযরত আব্দুল্লাহ বিয়াবান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জঙ্গল নামে পরিচিত। কথিত আছে, মাঝেমধ্যে জয়পাল তথা আবদুল্লাহকে এখনও গরীবে নাওয়াজের মাজারের আশেপাশে দেখা যায়।

সর্বশেষ জয়পালের ইসলাম গ্রহণের পর পৃথ্বীরাজের সমস্ত লোকজন ইসলাম গ্রহণ করলেন, বাকি থাকল শুধু পৃথীরাজ। বারবার খাজা গরীবে নাওয়াজের পক্ষ থেকে ঈমান আনার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বরং ইসলামের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত ছিলেন। এ অবস্থায় গরীবে নাওয়াজ একদিন জজবাতি হালতে পৃথ্বিরাজকে একটি চিঠি লিখে পাঠালেন যে, “আমরা জীবিত বন্দী অবস্থায় তোমাকে মুসলমানদের হাতে অর্পণ করলাম”। এ চিঠির পর পরই সুলতান শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরীর সাথে পৃথ্বীরাজের পরপর দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, ইতিহাসে যা তরাইনের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত সর্বশেষ যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ঘুরির হাতে জীবিত বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। পৃথ্বীরাজের সুচনীয়ভাবে পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সুচনা হয়। পতন হয়, পৌত্তলিক ও বর্বর সমাজ ব্যবস্থার, উত্থান হয় ইসলামী শাসন, নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির।

খাজা গরীবে নাওয়াজের ওপাতের আগে ভারতবর্ষে প্রায় চল্লিশ বছর ইসলামের প্রচার-প্রসারে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এসময় নব্বই লাখের অধিক মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন বলে ইতিহাস ও হজরতের জীবনী সূত্রে জানা যায়। হজরত খাজা গরীবে নাওয়াজের হাজারো কারামাত রয়েছে, যা এ সংক্ষিপ্ত কলেবরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে গাউসুল আজম পীরানেপীর দস্তগীরের সাথে সাক্ষাৎ ও ৫৬ দিনের সান্নিধ্য এরপর বাগদাদ আর আজমীরের হাজার মাইলের ব্যবধানে যখন গাউসেপাক বাগদাদ জামে মসজিদের মিম্বরে বসে ঘোষণা দিলেন ‘কদমি হাজিহি আলা রকবাতি কুল্লি ওয়ালিউল্লাহ’ অর্থাৎ- এ আমার পা, যা তাবৎ বিশে^র সকল অলিউল্লাহদের গর্দানের উপর। তখন আজমীর থেকে খাজা গরীবে নাওয়াজ মোরাকাবারত অবস্থায় মাটিতে মাথা রেখে ঘোষণা দিলেন, ‘ক্বলা বলা, আলা রাসি ওয়া আইনি’ অর্থাৎ- হ্যাঁ হ্যাঁ,গর্দানে নয় শুধু, আপনার কদমপাক আমার মাথায় ও চোখের উপর।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় এ দুনিয়া থেকে পর্দা করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তার বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী (রাহ.) তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। প্রতিবছর ১ রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমীর শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত। যাতে দেশ-বিদেশের নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের লাখো মানুষ সমবেত হয়। আল্লাহ আমাদের খাজা গরীবে নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ফয়ুজাত নসিব করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র:

১.তারিখে খাজায়ে খাজেগান, কৃত- প্রফেসর সামসু তাহরানী, 
২.খুতবাতে আজমীর, কৃত-ফয়জুল মুস্তফা আতিকী (রাহ.), 
৩.খিয়ারুল মাজালিস, কৃত-হামিদ কলন্দর (রাহ.), 
৪. কাশফুল মাহজুব, কৃত- আল-হাজবিরী, 
৫. হজরত খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী (রাহ্) এর মাজার, কৃত-পি.এম.কুরি, 
৬. সুলতান-এ হিন্দের দেশে, কৃত-মাওলনা বদিউল আলম রিজভী, 
৭. লেখকের ২০১৪ সালে সফর অভিজ্ঞতা, 
৮. ইন্টারনেট; এনসাইকো¬পিডিয়া অব ইসলাম, 
৯. ইসলামি বিশ্বকোষ, ই.ফা, ঢাকা, 
১০. ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, মুসলমান আমল, কৃত- ড. আবদুল করিম।
Tags

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!