পরিচিতি:
ইমামুত ত্বরিকত হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রা:) এঁর নবম বংশধর আল্লামা সৈয়দ আবু নসর মোহাম্মদ আবেদ শাহ মোজাদ্দেদী আল-মাদানী (রা:)। তিনি ৫৭ বছর বয়সে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থ্যাৎ বর্তমান বাংলাদেশে হিজরত করে চলে আসেন। এদেশে তিনি সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নকশবন্দী মুজাদ্দেদী ত্বরিকার একজন সূফিসাধক। সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী (রা:) কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর বংশধর হিসেবে ভাবা হয়। ব্রিটিশ ভারতে বেরলভী ভাবধারার সুন্নী আন্দোলনের অন্যতম হিসেবে বাংলাদেশী সুন্নীমতাদর্শীরা মনে করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সুন্নী জামাআতের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। তাঁর হাত ধরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠে যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবের মদিনা শরীফের জান্নাতুল বাকী মহল্লায় হযরত সৈয়দ শায়েখ মোহাম্মদ শাহ ইবনে হযরত সৈয়দ মাহমুদ শাহ এর ঔরশে ১২৮৪ হিজরী সনের শাবান মাসের ১৫ তারিখ (শবে বরাতের রাত্রী) সোবহে সাদেকের সময় সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী এর জন্ম গ্রহণ করেন। জানা যায় তিনি পিতার দিক থেকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) এর বংশধর এবং মাতার দিক থেকে হযরত ইমাম হাসান (রা:) এর বংশধর ছিলেন। জন্মের পর থেকে তিনি ২৮ বছর বয়স পর্যন্ত মদীনা শরীফে দ্বীনি শিক্ষার জ্ঞান অর্জন করেন।
ভারতে আগমন:
তিনি হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর বাতেনী নির্দেশে এবং ভারতের রামপুর ষ্টেটের নবাব কলেব আলী খাঁর অনুরোধে ইসলাম প্রচারার্থে তিনি ও তাঁর চাচা মাওলানা এরশাদ হুসাইন ভারতের রামপুরে আগমন করেন। ভারতে এসে তিনি বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাদিস গ্রন্থ অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। সেসময় ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের মধ্যে বেরলভী ও দেওবন্দী দুই দলে বিভক্ত ছিল। তখন সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী (রা:) কোরআন, হাদিস শরীফের সহিহ তাফসীর, সুন্নী আক্বীদা ও সূফীতত্ত্বের ইলম (জ্ঞান) দ্বারা বেরলভী ভাবধারায় বাহাস ও মোনাজেরার মাধ্যমে সুন্নী ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ইসলাম প্রচারের ধারাবাহিকতায় তিনি পাঞ্জাবের খৃষ্টান র্ধমাম্বলি প্রধানদের সমিপে ইসলামের (আমন্ত্রণ) দাওয়াত পৌঁছান এবং ইসলামী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানান। অত:পর এক সময় খৃষ্টান ধর্মাম্বলি প্রধানরা তাঁর সাথে বহাস করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং বহাসে পরাজিত হয়।
ভারতের শিয়া সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিও সুন্নীমতাদর্শ (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত) উপস্থানের মাধ্যমে ইসলামের মূলনীতি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেন এবং তাদের ভুল খন্ডন করে সুন্নী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এভাবে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নীয়ত প্রচারে ভূমিকা রাখেন এবং ব্রিটিশ ভারতের মুসলীম সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করেন। সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী কুরআন, হাদিস ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল দ্বারা মিলাদ-কিয়াম ও ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর গুরুত্ব প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন।
বহাস (তর্ক যুদ্ধ):
১৩৪৬ হিজরী সনে মিলাদ ও কিয়াম সর্ম্পকিত দলিল প্রমাণ উপস্থান করতে বহাসে অংশ গ্রহণ করেন এবং মিলাদ-কিয়াম এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। ১৩৪৮ হিজরী সনে দিল্লীর ফতেহপুর জামে মসজিদে ছয় উছুলি তাবলীগকে নতুন আবিষ্কার সাবস্ত করেন। এমনিভাবে দেওবন্দী ভাবধারার আলেম সম্প্রদায়ের সাথে সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী সুন্নীমতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় ইমামে আহলে সুন্নাত আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন ফাযায়েলে বেরলভী (রা:) এঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খান্দানে আলা হযরত হজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা কাদের রেজা খাঁন, সৈয়দ মুহাম্মদ কাসুয়াসুরী, মালেখুল ওলামা শাইখুল হাদিস আল্লামা জাফরুদ্দীন বিহারী সুন্নী ওলামাদের পক্ষে যোগদিয়ে বহাসে অংশ নেন।
বাংলাদেশে আগমন:
সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী (রা:) ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার জমীনে হিজরত করে রামপুর থেকে ৫৭ বছরের র্দীঘ বসবাসের মায়া ত্যাগ করে সমস্ত ধন সম্পদ ছেড়ে বাংলায় (তৎকালীন- পূর্ব পাকিস্তান) আসেন। তিনি বাংলার জমীনে এসে আবার শুরু করেন সুন্নীয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ১৯৫৩ সালে চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া থানার ক্বারী ইব্রাহীমের পুত্র কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে গ্রেফতার করান। এ মামলা থেকে অভ্যাহতির পর, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর পক্ষে রায় দিয়ে তাদের দায়ের করা মামলা বাতিল করে দেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামেও তিনি আবদান রেখেছেন বলে ধারনা করা হয়।
বাংলাদেশে এসে চাঁদপুর জেলাধীন হাজীগঞ্জ উপজেলার মোজাদ্দেদ নগর (ধেরেরা) গ্রামে বসতী স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ইলমে হাদিস শিক্ষার পন্থা চালু করেন। বায়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইলমে হাদিস অধ্যাপনার মধ্যদিয়ে হাজার হাজার ভক্ত, শিষ্য অনুসারী গড়ে তুলেন। জানা যায় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার অনুসারী ভক্তশিষ্য ছড়িয়ে রয়েছেন । পরবর্তীতে সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী (রা:) নূরানী হাত ধরে বর্তমান চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ধেরেরা গ্রামে ইমামে রাব্বানী দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৭৫ সালের ২৩শে এপ্রিল তিনি সিলেটের হবিগঞ্জে এক সুন্নী সম্মেলনে যোগদেন। এই সম্মেলনে সিলেটের খ্যাতনামা আলেমগণ উপস্থিত ছিলেন এবং অনেক জন তার প্রতিষ্ঠিত সুন্নী সংগঠন বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর সদস্য হয়ে অনেকে তাঁর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য যে আল্লামা আমিনুল ইসলাম জালালী, আল্লামা আবু সুফিয়ান খাঁন সহ আরো বহু ওলামায়ে আহলে সুন্নাত। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের সুন্নী সকল বিখ্যাত ওলামায়ে মাশায়েখগণ তার ছাত্র ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম- আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী, আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী, মুফতি গিয়াস উদ্দিন, আল্লামা ওছিয়ুর রহমান, আল্লামা ওবাইদুল হক নঈমী, আল্লামা আব্দুল বারী জিহাদী, আল্লামা আবু সুফিয়ান আল্-ক্বাদেরী, আল্লামা ওহীদুর রহমান জিহাদীসহ তারা তাঁর কাছে থেকে কুরআন, হাদিস ও ইসলামী শিক্ষার তালিম নেন।
ওফাত:
১৯৮৮ সালের ৮ অক্টোবর ১২৬ বছর বয়সে সৈয়দ আবেদ শাহ আল্-মাদানী (রা:) পরলোক গমন করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইমামে রাব্বানী দরবার শরীফে এই মহান গুণী অলিয়ে কামেল ও আলেমকে দাফন করা হয়। বর্তমানে সেখানেই তাঁর নূরানী মাজার শরীফ অবস্থিত। তাঁর জীবতকাল থেকেই ইমামে রাব্বানী দরবারে প্রতি বৎসর ওরস মাহফিল অনুষ্ঠান পালন হচ্ছে। তাঁর মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া চার সন্তানগণ উক্ত দরবারে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছে।