অনুচ্ছেদ : বাংলা ২য় পত্র - নবম ও দশম শ্রেণি, এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা (১ম পর্ব)
(toc)
বাক্য মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু সব সময় একটি বাক্যের মাধ্যমে মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এজন্য প্রয়োজন একাধিক বাক্যের। মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের সমষ্টিই অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদে কোনো বিষয়ের একটি দিকের আলোচনা করা হয় এবং একটি মাত্র ভাব প্রকাশ পায়। অনুচ্ছেদ রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যেমন-
- একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি মাত্র ভাব প্রকাশ করতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কথা লেখা যাবে না।
- সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো বাক্যের মাধ্যমে বিষয় ও ভাব প্রকাশ করতে হবে।
- অনুচ্ছেদটি খুব বেশি বড় করা যাবে না। লিখতে হবে একটি মাত্র প্যারায়। কোনোভাবেই একাধিক প্যারা করা যাবে না।
- একই কথার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- যে বিষয়ে অনুচ্ছেদটি রচনা করা হবে তার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সহজ-সরল ভাষায় সুন্দরভাবে তুলে ধরতে হবে। অনুচ্ছেদের বক্তব্যে যেন স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রকাশ পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
জাতীয় পতাকা
জাতীয় পতাকা একটি জাতির স্বাধীনতার প্রতীক। বিশ্বের প্রতিটি জাতির তাদের নিজস্ব জাতীয় পতাকা আছে। আমাদের দেশেরও একটি জাতীয় পতাকা আছে। এই একটি পতাকার জন্য আমাদের অনেক রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর আমরা এই পতাকাটি অর্জন করি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় ঘন সবুজ রঙের ওপর একটি লাল বৃত্ত থাকে। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে এর অনুপাত ১০:৬। লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ পাতাকার দৈর্ঘ্যরে এক-পঞ্চমাংশ। সবুজ রং তারুণ্যদীপ্ত প্রাণশক্তির জয়গান এবং বাংলাদেশের সবুজ মাঠ ও চিরহরিৎ উপক্রান্তীয় বনভূমিকে তুলে ধরে। লাল বৃত্তটি একটি নবগঠিত জাতির নতুন আশা ও আকাক্সক্ষা সমন্বিত একটি উদীয়মান সূর্যকে চিহ্নিত করে। জাতীয় পতাকা আমাদের গর্বের প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চূড়ায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিশেষ কিছু দিবসে এটি অর্ধনমিত রাখা হয়। আমাদের জাতীয় পতাকা রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে সর্বদা আমাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। এটি প্রতিনিয়ত স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সদা সচেষ্ট থাকা উচিত।
বাংলা নববর্ষ
নববর্ষ সকল দেশের সকল জাতিরই আনন্দ উচ্ছাস ও মঙ্গল কামনার দিন। পুরাতন বছরের জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে বছরের এই দিনটিতে নতুনকে আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশেও পয়লা বৈশাখে সকলের কল্যাণ প্রত্যাশা করে মহা ধুমধামের সাথে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। এটি বাংলাদেশের সর্বজনীন ও শ্রেষ্ঠ লোকউৎসব। প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালি এই উৎসব পালন করে থাকে। বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণে এবং স্বাধীনতা অর্জনে নববর্ষের তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনের গণনা শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। জমিদার ও নবাবেরা নববর্ষে পুণ্যাহ আয়োজন করতেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নববর্ষ পালন করায় সে আয়োজন দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে লেগে থাকে হাসি, গায়ে থাকে রঙিন জামা। নববর্ষে হালখাতা, বৈশাখী মেলা, ঘোড়দৌড় এবং বিভিন্ন লোকমেলার আয়োজন করে সাধারণ মানুষ। সংস্কৃতি সংগঠন ছায়ানট নববর্ষে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এতে আবহমান বাঙালির ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি থাকে সমকালীন সমাজ-রাজনীতির সমালোচনাও। এছাড়াও নানা বর্ণিল আয়োজনে দিনটিকে বরণ করা হয়। এই দিনে প্রত্যেক বাঙালি নিজের, বন্ধুর, পরিবার ও দেশের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। কোনো ধর্ম-গোত্র-শ্রেণির বন্ধনে বাঁধা পড়ে না বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন। ফলে আমাদের জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযু দ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে যে স্বাধীনতা তাকে চিরসমুন্নত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের প্রেরণা জোগাবে চিরদিন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করলেও প্রকৃত মুক্তি আসেনি বাঙালি জাতির। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ৫৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা, ৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করে। তখনই চূড়ান্ত স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২৫ই মার্চ মধ্যরাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের বর্বরতা চালায় দেশজুড়ে। বাংলারজনতা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানিদের অত্যাচার রুখে দেয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ চলে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ৩০ লক্ষ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, আমাদের চেতনা। এই চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেই আমাদের জাতি গঠনে কাজ করতে হবে।
একুশে বইমেলা
একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী চেতনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম আয়োজন হলো মহান একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এ মেলা চলে। বইমেলা উপলক্ষে বই বিক্রেতা ও প্রকাশকরা নানা সাজে বইয়ের স্টল বা দোকান সাজিয়ে বসেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সমাহার ঘটে। বইমেলা উপলক্ষে প্রচুর নতুন বইমেলায় আসে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বইও পাওয়া যায় এখানে। প্রতিদিন বইয়ের আকর্ষণে বই প্রেমিক মানুষেরা মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে আসে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি লেখক, ভাষাবিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা বইমেলায় আসেন। লেখক ও পাঠকদের মিলনমেলায় রূপ নেয় এই মেলা। এটি বাংলা একাডেমির একটি মহৎ উদ্যোগ। এ বইমেলার ফলে পাঠকরা এক জায়গা থেকে তাদের পছন্দের বই কিনতে পারে। এছাড়া বই কেনার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহও তৈরি হয়। একুশের বইমেলা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ জাগ্রত করে। এ বইমেলা এখন আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে সম্পৃক্ত।
প্রিয় শিক্ষক
সুন্দর এই পৃথিবীতে পিতা-মাতার বদৌলতে সন্তান জন্মলাভ করে ঠিকই কিন্তু সেই সন্তানের জীবনকে সার্থক এবং সফল করে তোলার পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষকের কাছে আমরা গ্রহণ করি জীবনের মূল্যবান পাঠ। জ্ঞানের পৃথিবীতে তিনি আমাদের দ্বিতীয়বার জন্মদান করেন। সুশিক্ষকের প্রভাব মানুষের জীবন চলার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যে শিক্ষক আমার হৃদয় মানসে ধ্রুবতারার মতো জেগে আছেন তিনি হলেন ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব বাবু হরিমন বিশ্বাস। তিনি আমাকে তাঁর সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। সবসময় আমার যতœ নিতেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল অনেক চমৎকার। আমাদের পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত অতিথি। তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের বাইরেও আমি যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় জানতে পারি সেজন্য তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না। স্যার ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ এক সুবিশাল ব্যক্তিত্ব। তিনি হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করতেন তা সবার সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতেন। তাই তিনি আজও আমার প্রিয় শিক্ষক এবং চিরদিন আমার জীবনাকাশে আদর্শের মূর্ত তারকা হয়েই প্রজ্জ্বলিত থাকবেন।
পিতা-মাতা
সন্তানের নিকট পিতা-মাতার স্থান সবার ওপরে। পিতা-মাতার মতো প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন সন্তানের কাছে আর কেউ নেই। পিতা-মাতাই সন্তানের সবচেয়ে বড় শুভাকাক্সক্ষী ও সবচেয়ে আপন। তাঁদের নিকট সন্তানরা এত বেশি ঋণী যে, এ ঋণ জীবনে শোধ করা সন্তানদের পক্ষে সম্ভব নয়। পিতা-মাতার কারণেই সন্তান এ পৃথিবীতে আসতে পারে। জন্মের পর মায়ের কোলই সন্তানের প্রধান আশ্রয়। সন্তানের লালন+পালনের জন্য পিতা-মাতাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। সন্তান অসুস্থ হলে তাঁরা আহার+নিদ্রা ভুলে তার পাশে বসে থাকেন। সর্বস্ব ব্যয় করে সন্তানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকেন। নিজে না খেয়ে হলেও সন্তানের জন্য তাঁরা আহার জোগান। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। মাতা-পিতা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে তাঁদেরকে আদর যত্নের মধ্যে রাখা আমাদের কর্তব্য। আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় পিতা-মাতাকে সুখী রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা। সন্তান যখন পিতা-মাতার মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তখনই তার জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।
শিক্ষাসফর
‘শিক্ষা সফর’ শব্দটি শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে দুটি মাধ্যম সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো বই এবং ভ্রমণ। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করলে মানুষ প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। এ অভিজ্ঞতা সব সময় মানুষের মনে অম্লান হয়ে থাকে। ছাত্রসমাজকে জ্ঞানের সংস্পর্শে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাসফরের আয়োজন করে থাকে। শিক্ষাসফরে একটি নির্দিষ্ট জায়গা পরিভ্রমণের মাধ্যমে অদেখাকে দেখা যায়, অজানাকে জানা যায় সফর মাত্রই রোমাঞ্চকর। আর তা যদি শিক্ষাকে কেন্দ্র করে হয় তবে তো কথাই নেই। আমাদের পাঠ্যশিক্ষার বিষয়টি শিক্ষাসফরের মাধ্যমে আরও পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। যেকোনো ঐতিহাসিক স্থান, জাদুঘর কিংবা বিশেষ কোনো স্মৃতিবিজড়িত স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষা লাভের পথ সুগম হয়। বাস্তবিক জীবনবোধের সাথে পরিচিত হতে হলে শিক্ষাসফরকে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। শিক্ষাসফর আমাদের জীবনবোধের পরিধিকে বিস্তৃত করে জ্ঞানকে পরিপূর্ণতা দান করে। এতে দৃষ্টি উন্মীলিত হয় এবং মানুষ নব নব অভিযানে অংশ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি একঘেয়েমি দূর করে বৈচিত্র্য এনে দিতে পারে শিক্ষাসফর। শিক্ষার পরিপূর্ণতা লাভে শিক্ষাসফর কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম।