হাতের লেখা সুন্দর করার সহজ উপায়
“কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং”-হাতের লেখা নিয়ে প্রায়ই এমন মন্তব্য শোনা যায় । অনেকে মনে করো, কম্পিউটারের এই যুগে হাতের লেখা ভালো না হলে কী আসে যায় । কিন্তু ঝকঝকে, সুন্দর হাতের লেখার কদর সব সময়ই আছে। আর এ জন্য বাড়ি থেকেই চর্চা শুরু হওয়া উচিত। যেদিন শিশুর হাতেখড়ি হলো, সেদিন থেকেই নজর দিন। তার হাতের লেখার দিকে।
কম্পিউটার ও মোবাইলের যুগে সুন্দর হাতের লেখার কি প্রয়োজন আছে? এমন প্রশ্ন আজকাল অনেকেই করো। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের এতে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। মানুষ সুন্দরের পূজারি বলে সুন্দর হাতের লেখার কদর কখনো ফুরোবে না। সুন্দর হাতের লেখা চিঠি, নোট বা আবেদনপত্র আজো যে কাউকে মুগ্ধ করে। গোটা গোটা মণি মুক্তোর মতো বর্ণগুলো সকলেরই নজর কাড়ে। কেজি ও প্রাইমারি স্কুল জীবন থেকেই সুন্দর হাতের লেখার জন্য চর্চা ও অনুশীলন শুরু করা উচিত।
শিল্পী হাশেম খান শিশুদের হাতের লেখা সুন্দর করার সহজ কিছু পরামর্শ দিলেন। "শিশুদের সামনে কারও সুন্দর হাতের লেখা তুলে ধরতে হবে, সেই লেখা অনুসরণ করে যাতে তারা নিজেদের লেখাও সুন্দর করতে পারে। প্রতিটি বর্ণ যাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, এমনভাবে লিখতে হবে।' বলেন তিনি। শিশুদের প্রায়ই তাগাদা দেওয়া হয় দ্রুত লেখার জন্য। হাতের লেখা খারাপ হওয়ার এটি আরেকটি কারণ বলে মনে করো তিনি। ঘড়ি ধরে দ্রুত লেখা অনুশীলন করা যেতে পারে এ ক্ষেত্রে। হাতের লেখা সুন্দর রেখে দ্রুত লেখায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে শিশুদের। প্রথম দিন হয়তো এক পাতা লিখতে অনেক সময় লাগবে। অনুশীলনের মাধ্যমে এরপর সময়টি ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে করো হাশেম খান।
সুন্দর হাতের লেখার জন্য অনুশীলনের বিকল্প নেই। বাড়িতে তো বাচ্চাকে অনুশীলন করাবেনই। বাইরেও আজকাল হাতের লেখা সুন্দর করানোর নানা কোর্স চালু হয়েছে। শিশু একাডেমীতে সুন্দর হাতের লেখা প্রশিক্ষণ বিভাগে কথা হলো শামীমা সুলতানার সঙ্গে। মেয়েকে নিয়ে এসেছেন তিনি। 'আমার লেখা ততটা ভালো ছিল না। কিন্তু আমি চাই, আমার মেয়ের লেখা যেন সুন্দর হয়। সে জন্যই ওকে এখানে এনেছি।'
শিশুদের হাতেখড়ি হওয়ার পর খাতা-কলমে লেখা কিছুটা আয়ত্তে চলে এলেই হাতের লেখা সুন্দর করার অনুশীলন শুরু করা উচিত। এ জন্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন শিশু একাডেমীর সুন্দর হাতের লেখা প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রশিক্ষক মেজবাহ উদ্দীন। 'তাড়াহুড়ো এবং অমনোযোগিতা বাচ্চাদের হাতের লেখা খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। বলপয়েন্ট কলম নয়, বরং বাচ্চাদের উচিত পেনসিল দিয়ে লেখা। মূল পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিন এক পাতা করে লেখা শেখানো অনুশীলন করানো উচিত।' বলেন তিনি।
তাঁর পরামর্শ হলো-
- বাচ্চাদের খাতার পুরো লাইন ভরে লেখানো উচিত।
- প্রতিটি বর্ণ যেন সমান হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- পেনসিলের শিষ থেকে এক ইঞ্চি দূরত্বে পেনসিল ধরতে হবে।
- সঠিক উচ্চতার চেয়ার-টেবিলে বসে লেখা লিখতে হবে। মেরুদন্ড সোজা করে বসতে হবে।
- প্রাথমিক পর্যায়ে বর্ণগুলো সোজা করে লিখতে হবে।
- তিনকোনা বর্ণগুলো সবচেয়ে সোজা। আগে সে অক্ষরগুলো থেকে লেখা অনুশীলন শুরু করতে পারে। যেমন- ব, ক।
- খাতায় বর্ণের আকারে ফোঁটা দিয়ে দাও। শিশুকে তার ওপর হাত ঘুরিয়ে বর্ণ লেখা অনুসরণ করান।
- কোন বর্ণে মাত্রা আছে, কোনটায় অর্ধমাত্রা ইত্যাদি ভালোমতো জেনে সে অনুযায়ী অনুশীলন করান।
আমাদের প্রিয় বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ন্যায় অনেকের হাতের লেখা খুবই সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দীয় ছিল। জানা যায়, আগের যুগে স্কুল-পাঠশালায় অসুন্দর হাতের লেখার জন্য বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা ছিল। এখনো কোন কোন স্কুলে ভাল হাতের লেখার জন্য পৃথক নম্বর বরাদ্দ করা হয়। অনেক সময় সুন্দর হস্তলিপি পরীক্ষকের মনে উদার মনোভাব তৈরি করে বলে বেশি নম্বর পাওয়া যায় আবার নম্বর না পেলেও দুঃখ নেই। সুন্দর হাতের লেখার জয় একদিন হবেই। এটা সৌন্দর্যের পরিচয় বহন করে বলে পরবর্তীতে সুন্দর হাতের লেখার অভ্যেস ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হয়। সুন্দর হাতের লেখার প্রশংসা সবাই করে। লেখা সুন্দর হলে পরীক্ষক ধরে নেন এটি ভাল ছাত্রের খাতা। শিক্ষাক্ষেত্রের সকল স্তরেই হাতের লেখার উপর গুরত্ব আরোপ করা হয়।
লেখা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা সবাই করে। কিন্তু সবাই কি পারে? কিভাবে লেখা সুন্দর ও দ্রুত করা যায়, আসুন জেনে নিই।
লেখা সুন্দর করার উপায়
১. বেশি লেখার অভ্যেস গড়ে তোলা উচিৎ। লিখতে লিখতে এক সময় অসুন্দর লেখাও সুন্দর হয়ে উঠে।২. লেখার সময় নিরিবিলি পরিবেশ থাকতে হবে। মনোযোগ থাকলে লেখা সুন্দর করার চেষ্টা করা যায়।
৩. সুন্দর লেখাকে অনুকরন করা উচিৎ।
৪. বাক্য ও বানান নির্ভুল হওয়া উচিৎ তাতে লেখায় কাটা ছেড়া হওয়ার সম্ভবনা কমে যায়।
৫. অনেকের লিখতে গেলে লাইন বাকা হয়ে যায়। এধরনের লেখা কখনো সুন্দর দেখায় না। তাই লেখা সোজা করে লিখতে হবে।
৬. হাতের লেখা সুন্দর করতে হলে ছোট বেলাই হচ্ছে আদর্শ সময়। তাই শিশু কাল হতে লেখার চর্চা করানো উচিৎ।
৭. লেখা শুরু করলে প্রথমে লেখা সুন্দর থাকে পরে ধীরে ধীরে লেখা খারাপ হতে থাকে।তাই লেখার মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে হবে।
৮. হাতের লেখা সুন্দর করতে হলে ছোট বেলা হতেই শিশুদের চিত্র আকা শিখাতে হবে।
৯. কিছুদিন পর পর পূর্বের হাতের লেখার সাথে মিলিয়ে তুলনা করে নিতে হবে।
কীভাবে দ্রুত লেখা যায়
১. দ্রুত লেখার জন্য মুখস্ত শক্তি ভাল হওয়া প্রয়োজন । মনে রাখার উপর দ্রুত লেখা অনেকাংশে নির্ভর করে।২. লেখার সময় টেবিল অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও গোছানো থাকতে হবে। অগোছালো টেবিলে গুছিয়ে লেখা সম্ভব হয় না।
৩. লেখার টেবিলে পরিমানমত আলো থাকতে হবে। ৪. বসার চেয়ারটি আরাম দায়ক হতে হবে। চেয়ারের উচ্চতা টেবিলের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ন হতে হবে, যেনো লিখতে অসুবিধা না হয়।
৫. লেখার সময় ওভার রাইটিং করা উচিৎ নয়। এতে লেখার সৌন্দর্য ব্যাহত হয়।
৬. দ্রুত লেখার জন্য ভার কাগজ ও কলম ব্যবহার করা উচিৎ।
৭. সময় মেপে দ্রুত লেখার চেস্টা করা উচিৎ।
৮. লেখার সময় একাগ্রতা একটি গুরুত্ব পূর্ন বিষয়। কোন বিষয় গভীর মনোযোগ নিয়ে লিখলে লেখার গতি বেড়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হল, বাল্যকাল থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের লেখা সুন্দর করা যায় কিভাবে? বাংলা ও ইংরেজি উভয় লেখাই সুন্দর হওয়া চাই। এজন্য শিক্ষার মূলমন্ত্র ‘লেখা-পড়া' অর্থাৎ আগে লেখা ও পরে পড়া নীতি অনুসরণ করে বেশি বেশি লিখতে হবে। বেশি লেখার ফলে পড়াটাও পেনসিলের দাগ বা কালির অক্ষরের ন্যায় মনে গেঁথে যায়। হাতে খড়ি অনুষ্ঠান থেকেই গৃহশিক্ষক বা বাবা-মাসহ পরিবার-পরিজনের সহায়তাও একান্ত পরিচর্যা লাভ করলে ছেলে-মেয়েদের হাতের লেখা সুন্দর না হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পার। সোনামণিদের হাতের লেখা সুন্দর করতে পারে যদি-
- পেনসিলটি সঠিকভাবে ধরতে শেখানো যায়
- শুরুতে লাইন টানা কাগজে লেখার চর্চা করা যায়।
- বল কলমের পরিবর্তে প্রাথমিক পর্যায়ে পেনসিলের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যায়।
- প্রতিদিন একপৃষ্ঠা করে বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা চর্চা করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে সুন্দর হস্তাক্ষর নিয়ে কাজ করছো এমন একজন হলেন হেমায়েত মোহাম্মদ জারিফ।
তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর হাতের লেখা বিভাগের প্রধান শিক্ষক। এছাড়া রাজধানীর ফার্মগেটে 'থ্রি ফিংগারস হ্যান্ড রাইটিং ডেভেলপমেন্ট একাডেমী' নামে তার একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
তিনি এশিয়া মহাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি ৩০ বছরের গবেষণা ও সাধনায় এ পর্যন্ত ৪২৮ রকম সুন্দর লেখার ধারা আবিষ্কার করেছেন। এ বছর বইমেলায় তার হাতের লেখা সুন্দর করার করা সংক্রান্ত পাঁচটি সিরিজ বই প্রকাশিত হয়েছে। তার পরামর্শ অনুযায়ী সুন্দর হাতের লেখার আমার হল-
- অক্ষরের সঠিক ব্যবহার করতে হবে
- অক্ষরগুলো ঘন করে লিখতে হবে।
- লাইন অবশ্যই সোজা রাখতে হবে
- অক্ষর ছোট-বড় বা মোটা-চিকন করা যাবে না
- অক্ষর বা শব্দ বেশি কাটাকাটি করা চলবে না
- খুব দ্রুত লেখার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে
- শব্দ ফাঁকা করে লিখতে হবে। এক শব্দ থেকে আরেক শব্দের দূরত্ব হবে এক অক্ষর সমপরিমাণ। ছোটদের ক্ষেত্রে ২ অক্ষর ফাঁকা হলেই ভাল ।
- বামপাশের মার্জিন ঠিক রাখতে হবে। ডানপাশের মার্জিন যথাসম্ভব ঠিক রেখে শেষ করতে পারলে উত্তম। তা সম্ভব না হলে পৃথক শব্দ বাম পাশ থেকেই শুরু করা বাঞ্ছনীয় ।
- সর্বোপরি, স্টাইল বার বার পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, আশা করি তোমরা সুন্দর হাতের লেখার জন্য আরো সিরিয়াস হবে। পরীক্ষার খাতা ও কাগজ-কলমের ব্যবহার যতদিন থাকবে, ততদিন সুন্দর হাতের লেখার গুরুত্ব কখনো কমবে না ।