অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও, আলফ্রেড মার্শাল ও এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা দুটির তুলনামূলক আলোচনা কর

Join Telegram for More Books
অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও, আলফ্রেড মার্শাল ও এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা দুটির তুলনামূলক আলোচনা কর

ফাজিল ইসলামী অর্থনীতি ১ম পত্র: ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক বিষয়

অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও, আলফ্রেড মার্শাল ও এল. রবিন্স প্রদত্ত অর্থনীতির সংজ্ঞা দুটির তুলনামূলক আলোচনা কর


ভূমিকা:

বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হচ্ছে অর্থনীতি। মানব জীবনের প্রতিটি কাজ-কর্মের সাথে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত মানব কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। তদুপরি অর্থনীতি আমাদের বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করে। এছাড়া অর্থনীতিবিদগণ যুগে যুগে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণে রবিন্সের সংজ্ঞা আজও প্রামাণ্য সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত।



অর্থনীতি শব্দের উৎপত্তি:

প্রাচীনকালে অর্থনীতির ইংরেজি পরিভাষা ছিল Political Economy আলফ্রেড মার্শাল প্রথম Economy শব্দের ব্যবহার করেছেন। আর Economy শব্দটি এসেছে গ্রীক Oikos ও Nomos শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে Oikonomia শব্দ হতে। গ্রীক ভাষায় Oikos দ্বারা 'গৃহ' (A house) এবং Nomos দ্বারা 'বিধি'কে (A law) বুঝানো হতো। এভাবে Oikonomia দ্বারা Household Management বা 'গার্হস্থ্য ব্যবস্থাপনা' বুঝানো হতো। পরবর্তীকালে একই অর্থ ও ভাব প্রকাশের জন্যে ইংরেজিতে Economics শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

অর্থনীতির সংজ্ঞা : অর্থনীতির বহু সংজ্ঞা রয়েছে। অর্থনীতি একটি গতিশীল বিষয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। একটি গতিশীল বিষয় হিসেবে অতীতের বিভিন্ন সময়ে দেয়া অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন সংজ্ঞার অনেকগুলো আজ কতিপয় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: অর্থনীতির কতিপয় প্রামাণ্য সংজ্ঞা নিম্নে উদ্ধৃত হলো-

  1. খ্যাতনামা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ সর্বপ্রথম পৃথক বিষয় হিসেবে অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণে প্রয়াসী হন। তাঁর মতে, অর্থনীতি হলো "An enquiry into the nature and causes of the wealth of nations." অর্থাৎ, “জাতিসমূহের সম্পদের কারণ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুসন্ধানে নিয়োজিত শাস্ত্রই অর্থনীতি।” তাঁর মতে, অর্থনীতি হলো সম্পদের বিজ্ঞান। কিন্তু এ সংজ্ঞা অত্যন্ত সীমিত এবং অসম্পূর্ণ। এ সংজ্ঞায় সম্পদের প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
  2. ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শালের মতে, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যকলাপ আলোচিত হয়।” (Economics is the study of mankind in the ordinary business of life.)
  3. অধ্যাপক এ. ভি. পিগুর মতে, “অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞানের ঐ অংশ যা মানব কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করে।” এ সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।
  4. ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিওনেল রবিনসের মতে, “যে বিজ্ঞান মানুষের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে বিকল্প ব্যবহারোপযোগী সীমিত সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে মানব আচরণ পর্যালোচনা করে তা-ই অর্থনীতি।" (Economics is a science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.) রবিনসের এ সংজ্ঞায় সম্পদ বা কল্যাণ কোনোটিরই উল্লেখ নেই। উল্লেখ রয়েছে মানুষের প্রয়োজন মিটানোর; আর ব্যবহার্য উপকরণসমূহের, অপ্রাচুর্যের কথা।
  5. অধ্যাপক কেয়ার্নক্রসের মতে, "অর্থনীতি এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান, যা মানুষ কিভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের অভাবের সাথে দুষ্পাপ্যতার সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করে, তা-ই আলোচনা করে।" (Economics is a social science studying how people attempt to accomodate scarcity to their wants and how there attempts interact through exchange.) আলোচ্য সংজ্ঞাটির কোন মৌলিকত্ব নেই।
  6. স্টোনিয়ার এবং হেগের মতে, "অর্থনীতি মূলতঃ স্বল্পতা ও স্বল্পতাজনিত সমস্যাদির আলোচনা শাস্ত্র।" (Economics is fundamentally a study of scarcity and of the problems which scarcity give rise.)
  7. অর্থনীতিবিদ Bober-এর মতে, "অর্থনীতি হলো স্বল্প উপকরণসমূহের বিলিবণ্টন এবং কর্মসংস্থান ও আয়ের নির্ধারক বিষয়সমূহের আলোচনা।" (Economics can be briefly defined as the study of administration of scarce resources and of the determinants of employment and income.)
  8. অধ্যাপক ফাইনার বলেন, "অর্থনীতিবিদগণ যা-ই আলোচনা করেন, তা-ই অর্থ শাস্ত্রের আওতাভুক্ত।"
  9. অর্থনীতিবিদ বোল্ডিং এর মতে, "অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানব কল্যাণ অর্জন করা।"
  10. জে.এস. মিল বলেন, "অর্থনীতি হচ্ছে সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যবহারিক শাস্ত্র।"
  11. এডউইন ক্যানান বলেন, "অর্থনীতি বৈষয়িক কল্যাণের উপায় সংক্রান্ত আলোচনা।" (Economics is a study of the causes of meterial welfare.)


মার্শাল ও রবিনসের অর্থনীতির সংজ্ঞার তুলনা:

মার্শালের অর্থনীতির সংজ্ঞা: ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মার্শালের মতে, "অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ আলোচিত হয়।" (Economics is the study of mankind in the ordinary business of life.)

মার্শালের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য:
  1. সাধারণ কার্যাবলি মানব জীবনের সাধারণ কার্যাবলি বলতে মার্শাল অর্থ উপার্জন ও অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত কাজকে বুঝিয়েছেন।
  2. বস্তুগত দ্রব্য: মার্শালের মতে, বস্তুগত দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ ও ব্যবহার অর্থনৈতিক কাজ এবং অবস্তুগত দ্রব্য অর্থনীতির আলোচনার বহির্ভূত।
  3. সামাজিক বিজ্ঞান: মার্শাল অর্থনীতিকে একটি সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমাজ বহির্ভূত কারো কার্যাবলি অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় নয়।
  4. মানব কল্যাণ মার্শাল তাঁর সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, সম্পদ মানব কল্যাণের বাহন মাত্র।

মার্শালের সংজ্ঞার সমালোচনা:পরবর্তীকালে অর্থনীতিবিদগণ মার্শালের সংজ্ঞার সমালোচনা করেছেন। যেমন-

  1. কল্যাণমূলক না হলেও বিশেষ কার্যাবলি অর্থনীতির আওতাভুক্ত।
  2. অবস্তুগত দ্রব্যও মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে।
  3. অর্থনীতি নীতিশাস্ত্রের কাজ করে না।
  4. মানব কল্যাণ অর্থের দ্বারা পরিমাপযোগ্য নয়।
  5. এ সংজ্ঞায় মানব জীবনের মৌলিক সমস্যার উল্লেখ নেই।

অধ্যাপক এল. রবিনসের সংজ্ঞা: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক লিওনেল রবিনসের মতে, "যে বিজ্ঞান মানুষের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে বিকল্প ব্যবহারোপযোগী সীমিত সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে মানব আচরণ পর্যালোচনা করে, তা-ই অর্থনীতি।" (Economics is a science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.)


রবিনসের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য:
  1. অসীম অভাব: মানুষের অভাব অসীম এবং অভাবের প্রকৃতি ও পরিমাণ বিভিন্ন।
  2. সীমিত সম্পদ: অভাব পূরণোপযোগী সম্পদ ও সময় অত্যন্ত সীমিত।
  3. সমন্বয় সাধন: সীমিত সম্পদ এবং অসীম অভাবের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা যায়, তা রবিনসের সংজ্ঞায়িত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
  4. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার সম্পদের যোগান সীমিত বলে একই সম্পদ মানুষের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
  5. অভাবের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় অভাবের সংখ্যা বেশি, সম্পদ সীমিত। এজন্যে অত্যাবশ্যকীয় অভাবগুলো প্রথমে পূরণ করতে হবে। অতঃপর সম্ভব হলে আরামপ্রদ ও বিলাসজাত দ্রব্যের অভাব পূরণ করতে হবে।

রবিনসের সংজ্ঞার সমালোচনা: রবার্টসন, কেয়ার্নক্রস, বোল্ডিং প্রমুখ অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রবিনসের প্রদত্ত সংজ্ঞাটির সমালোচনা করেছেন। যথা-

  1. রবিনসের সংজ্ঞায় অর্থনীতির বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা লক্ষণীয়।
  2. রবিনসের সংজ্ঞায় মানব কল্যাণের উল্লেখ নেই।
  3. এ সংজ্ঞায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর আলোকপাত করা হয় নি।
  4. এ সংজ্ঞায় বিনিময় ধারণাটি সংযোজিত হয় নি।
  5. রবিনস অর্থনীতিকে শুধু মূল্য নিরূপণ তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
  6. রবিনসের সংজ্ঞায় বেকার সমস্যা সংক্রান্ত কোন আলোচনা করা হয় নি।
  7. রবিনস তাঁর সংজ্ঞায় জটিল শব্দ ব্যবহার করেছেন, এর ফলে অর্থনীতি একটি দুর্বোধ্য বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে।

উপসংহার:

অর্থনীতি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের সংজ্ঞা আলোচনা করলে দেখা যায়, তাদের কারোর সংজ্ঞাই ত্রুটি মুক্ত নয়। অধ্যাপক মার্শাল ও রবিনসের সংজ্ঞা নানাদিক থেকে সমালোচিত হলেও সামগ্রিক বিচারে উভয় সংজ্ঞাই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যেই এ দুজনের সংজ্ঞা অদ্যাবধি অর্থনীতিবিদদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয়।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!